দেশে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে চাহিদার ৬২ শতাংশ

চট্টগ্রামে তীব্র হয়েছে গ্যাস সংকট এখনো বন্ধ একটি এলএনজি টার্মিনাল

সুজিত সাহা ও আবু তাহের

দেশজুড়ে আরো তীব্রতা পেয়েছে গ্যাস সংকট। মোট চাহিদার ৬২ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে জ্বালানি বিভাগ। এতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন। অন্যদিকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারছে না অধিকাংশ শিল্প-কারখানা। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় শিল্প খাতের উদ্যোক্তা সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা চিঠি দেয়া হয়েছে জ্বালানি বিভাগে। সর্বশেষ গতকালও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সংকটের তীব্রতা নিয়ে দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (সিসিসিআই) পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বরাবর একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। 

সংকট তীব্রতা পেয়েছে আবাসিক ও পরিবহন খাতেও। দিনের সিংহভাগ সময় চুলা জ্বলছে না রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অনেক আবাসিক এলাকায়। দুর্ভোগ বাড়ায় গ্রাহকরা অনেকেই ঝুঁকছেন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দিকে। গ্যাসের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের জট বাড়ছে সিএনজি স্টেশনের বাইরে। 

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুট। যদিও স্বাভাবিক সময়ে সরবরাহ থাকে প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে গ্যাস সরবরাহ হয় ৮৫ কোটি ঘনফুট। এ দুই টার্মিনালের একটি বন্ধ রয়েছে। ফলে সারা দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২৫৫ কোটি ঘনফুট। সব মিলিয়ে দেশে এখন গ্যাসের সরবরাহ হচ্ছে মোট চাহিদার ৬২ শতাংশ। 

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার বক্তব্য হলো কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনালটির (এফএসআরইউ) সংস্কারকাজ এখনো শেষ হয়নি। এটির সংস্কার শেষ হলেই গ্যাসের সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। এছাড়া এখন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানাগুলোয়ও গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া শিল্প খাতে গ্যাসের সংকট কাটিয়ে উঠতে নতুন পরিকল্পনা করছে জ্বালানি বিভাগ। 

 পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় কিছুটা গ্যাস কম সরবরাহ হচ্ছে। এর বাইরে সার কারখানায় গ্যাসের জোগান কিছুটা বেড়েছে এবং নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। যে কারণে কিছুটা সংকট রয়েছে। আমরা শিল্পে সংকট কাটানোর জন্য নতুন পরিকল্পনা করেছি। সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে।’

চট্টগ্রামমুখী গ্যাসের বড় একটি অংশ এখন সরবরাহ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে নির্মিত বৃহৎ সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও এখন গ্যাসের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এখানে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা গড়ে ৪০-৪৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ হয় ২৮ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ১০ কোটি ঘনফুটের বেশি ব্যবহার হয় চট্টগ্রামের দুটি সার কারখানা ও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। বাকি গ্যাস পায় শিল্প ও আবাসিক খাত। এ সংকটের মধ্যেই আবার সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে দুই-তিন কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণের কাজটি সম্পন্ন হয় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মাধ্যমে। এখানকার গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস) প্রকৌশলী শফিউল আজম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এলএনজি থেকে পাওয়া গ্যাসের সরবরাহ কমায় কেজিডিসিএলের জন্য বরাদ্দও কমেছে। তাছাড়া গত কয়েক দিনে কারিগরি সমস্যায় সরবরাহ আরো বিঘ্নিত হয়েছে। শীতের কারণে লাইনে চাপ কমে যাওয়া এবং সার ও বিদ্যুৎ কারখানাগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস বাড়িয়ে দেয়ার কারণেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাতে সরবরাহ কমেছে। তবে কয়েকদিন সংকট কিছুটা তীব্র হলেও এখন সেটি কমে গেছে। গ্যাসের প্রাপ্তি বাড়লে আগামী কিছুদিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ 

নারায়ণগঞ্জে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণ গ্যাস প্রয়োজন। সরবরাহ সংকটে এতদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে আনা যায়নি। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটের মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এখন শীতকাল হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা এমনিতেই কম। এ অবস্থায় অপরিহার্য না হলেও কেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। আবার গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের ভরা চাহিদার মৌসুমে যদি গ্যাস সংকট আরো তীব্রতা পায়, তখন হয়তো এগুলোকেও প্রয়োজনমতো গ্যাস সরবরাহ করা যাবে না। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেজিডিসিএলের অপারেশনস বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘‌ডলার সংকটসহ নানা কারণে দেশে সার, কয়লা ও জ্বালানি আমদানি কমেছে। বিকল্প হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আমদানীকৃত এলএনজি ব্যবহার করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।’ 

গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় শিল্প খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছে সিসিসিআই। সংগঠনটির গতকালের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‌চট্টগ্রামে দুটি সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বেড়েছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে কারণে শিল্প-কারখানা ও আবাসিকে তীব্র আকারে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় শিল্প খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

দেশে এ মুহূর্তে গ্যাস সরবরাহে সার কারখানাগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বেশি। যদিও এসব কারখানারও চাহিদার পুরোটা পূরণ হচ্ছে না। পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণের তথ্য অনুযায়ী, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (জেএফসিএল) গ্যাসের চাহিদা ছিল ৪ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ দেয়া হয়েছে ৪ কোটি ৩৬ লাখ ঘনফুট। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (এএফসিএল) ৫ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি ঘনফুট। সিইউএফএলে চাহিদা ছিল ৫ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। সরবরাহ হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি ঘনফুট। কাফকোর ৬ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ৪ কোটি ৮ লাখ ঘনফুট। সাড়ে ৪ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে এসএফসিএল সরবরাহ পেয়েছে ৪ কোটি ৬ লাখ ঘনফুট। 

সরবরাহ কমায় কারখানায় গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ পাচ্ছে না তৈরি পোশাকসহ দেশের শিল্প খাতের কারখানাগুলো। এসব কারখানার অনেকগুলোকেই এখন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বিভিন্ন খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, অধিকাংশ কারখানাই এখন গ্যাসের অভাবে সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কথা বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। এ সংকট অব্যাহতভাবে চলছে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভার এলাকার কলকারখানায় গ্যাস সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। গ্যাস না পাওয়ায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কারখানা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন করতে পারছে। নির্বাচনের পর গ্যাসের বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারকে আবারো অবহিত করব। এরপর যদি কোনো সমাধান আসে, তাহলে ভালো।’

গ্যাসের সংকট সমাধানের দাবি তুলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর গত ৫ ডিসেম্বর চিঠি দিয়েছিল পোশাক খাতের নিটওয়্যার শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ। ওই চিঠি দেয়ার পর প্রায় এক মাস পেরোলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটে নিট কারখানা এক প্রকার অচল। এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর হতে পারে না। গত ২৪ ঘণ্টায় বলার মতো কোনো গ্যাসের চাপ পাইনি। এ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দফায় দফায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দিয়েছি। কোনো প্রতিকার পাইনি। গতকালও (মঙ্গলবার) পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিকেএমইএ নেতাদের বৈঠক হয়েছে। তিনি কিছুটা সরবরাহ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু আদৌ এটার কার্যকারিতা কতটুকু, তা জানি না। এভাবে চলতে থাকলে নিট শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এ খাতে রফতানি আয় এরই মধ্যে ব্যাপক হারে কমে গেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন