এইচএসসির ফলে প্রভাব

ইংরেজির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না শিক্ষার্থীরা

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ইংরেজি বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, এ বিষয়েই সর্বাধিক ছাত্রছাত্রী ফেল করছে। এবারের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলেও সে চিত্র ফুটে উঠেছে। পদার্থ, রসায়ন কিংবা আইসিটির মতো বিষয়ের তুলনায়ও শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে খারাপ করেছে। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক পাসের হার সবচেয়ে বেশি বাংলায়, ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম ইংরেজিতে, ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আইসিটি ও পদার্থবিজ্ঞানে ৯২ দশমিক ৪৬, রসায়নে ৯২ দশমিক শূন্য ৭, অ্যাকাউন্টিংয়ে ৮৪ দশমিক ৯৬ ও পৌরনীতিতে গড় পাসের হার ৯৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। 

চলতি বছরে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ইংরেজিতে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড, পাসের হার ৭৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যান্য বোর্ডের মধ্যে ঢাকায় ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৩ দশমিক ১৮, কুমিল্লায় ৮১ দশমিক ৯৮, যশোরে ৭৭ দশমিক ৩৬, চট্টগ্রামে ৮৮ দশমিক ৯১, বরিশালে ৮৬ দশমিক শূন্য ১, সিলেটে ৮২ দশমিক ১৯ ও দিনাজপুরে ইংরেজিতে পাসের হার ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ।

বিগত কয়েক বছরের ফলাফল তুলনা করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতি বছরই অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ইংরেজিতে খারাপ ফলাফল করেছে। তবে গত দুই বছর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া পরীক্ষায় পাসের হার কিছুটা বেড়েছিল। এর আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালে ইংরেজিতে পূর্ণ নম্বরেই পরীক্ষা দেয় শিক্ষার্থীরা। ওই বছর সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে বিষয়টিতে গড় পাসের হার ছিল প্রায় ৯১ শতাংশ, যা এবারের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি।

উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি-ভীতি, শিখন পদ্ধতির জটিলতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং করোনাকালীন শিখন ঘাটতিই শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে খারাপ ফলাফলের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন উইং থেকে করা সমীক্ষায় বা জরিপেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে ভীষণ দুর্বলতা নিয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হচ্ছে। আবার এ বিষয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে করা জরিপে দেখা যায়, তাদের অবস্থাও করুণ। ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই নেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।

রাজধানীর শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক মো. সোহেল আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের দেশে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষায় শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। বিশেষ করে গ্রামাটিক্যাল বিষয়ে এ পার্থক্য প্রকট। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ গ্রামারে দুর্বল থাকে, যা ফলাফলে প্রভাব ফেলে। এছাড়া আমাদের শিখন পদ্ধতি কমিউনিকেটিভ না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারে না এবং ফলাফল খারাপ করে।’

তিনি বলেন, ‘‌ইংরেজিতে ভালো ফলাফল করতে হলে আমাদের শিখন পদ্ধতিটা যোগাযোগনির্ভর করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে চর্চার মাধ্যমে শিখবে। তখন তারা একটা বিষয় খুব সহজে মনে রাখতে পারবে এবং সহজেই ভুলবে না। এছাড়া শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’

এইচএসসি পরীক্ষার ফলে এবার দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে যশোর। এ বোর্ডে পাস করেছে কেবল ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী। অথচ গত বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে এবার ফলাফলে খারাপ করার কারণ জানিয়ে বোর্ডটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবিব জানান, শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি ফেল করার কারণেই পাসের হার কমেছে। একই কারণে অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়নি।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ইংরেজি বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, এ বিষয়েই সর্বাধিক ছাত্রছাত্রী ফেল করছে। এ বিষয়ে ড. মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘‌ইংরেজি বিদেশী ভাষা হওয়ায় সবসময়ই এ বিষয়ে ফলাফলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকে। তবে এ বছর আমাদের ইংরেজিতে এত খারাপ ফলাফল অপ্রত্যাশিত ছিল। বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ইংরেজি-ভীতি, কলেজে অনুপস্থিতি এবং এইচএসসি পর্যায়ে এবার সময়স্বল্পতা ফলাফল খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া করোনাকালে একটি শিখন ঘাটতিও ছিল। অনলাইন ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থীই অংশগ্রহণ করেনি। সেগুলোর প্রভাবও পড়েছে। তবে এ মাসে কিংবা আগামী মাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে খারাপ ফলাফলের কারণ এবং উত্তরণের উপায় নির্ণয়ের মাধ্যমে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করেছি আমরা।’

কলেজ পর্যায়ে ইংরেজিতে ভালো ফলাফলের জন্য শিখন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর স ম আব্দুস সামাদ আজাদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমরা সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগ করলেও ইংরেজি ব্যতিক্রম। এটি এখনো মুখস্থনির্ভর। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ইংরেজি না বুঝে শিখছে, যা ফলাফলে প্রভাব ফেলছে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পাঠদানের বিষয়ে যা শিখছেন তার সঠিক প্রয়োগ তারা করছেন কিনা সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা কোনো বিষয় ভালোভাবে শেখালে শিক্ষার্থীরা সহজেই সে বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারবে।’

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, শুধু শিখন পদ্ধতি কিংবা প্রশিক্ষিত শিক্ষকই নয়। দেশের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এবং বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌শিক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, মেধাবী মানুষ প্রয়োজন। আমাদের এখানে ইংরেজির মান ভালো না হওয়ার কারণ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতিসহ নানা রকম বিষয় কাজ করে। পাশাপাশি শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন সেটি নেই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত নয় এবং তারা উপযুক্ত সম্মান পান না। ফলে শিক্ষায় যে মেধাবী মানুষ আকৃষ্ট হবে সেটি ঘটছে না।’

এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘‌ইংরেজি শিক্ষায় এখন ডিরেক্ট মেথড অনুসরণ করা হয়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরামর্শে এটি করা হয়। তারা তাদের বাজার তৈরির জন্য এ কাজ করে। কিন্তু এগুলো নয় বরং ভালো গল্প, কবিতা, জীবনের গল্পসংবলিত টেক্সট বই দরকার ছিল, যা শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়াবে। তাহলে তারা বিষয়টি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন