অভিমত

মেগা প্রকল্পে বিগ পুশ: রাজনৈতিক কারণ ও বাস্তবতা

পাপলু রহমান

যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ক্রমে এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত ৫২ বছরে দেশে অনেক ভৌত অবকাঠামো হয়েছে। শুরুর দিকে বিদেশী সহযোগিতা নির্ভর হলেও বেশকিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নেই উন্নয়ন অবকাঠামো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। দেশে প্রতিটি সরকারের আমলেই উন্নয়নের ধারা ছিল। সব সরকারের কাছে অবকাঠামো উন্নয়ন আকর্ষণীয় ছিল। তবে ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় থাকা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় উল্লেখযোগ্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হয়েছে। 

সাধারণত মেগা প্রকল্প হলো বড় আকারের জটিল উদ্যোগ। এর বরাদ্দের পরিমাণ থাকে শতকোটি ডলারের ওপর। বাস্তবায়নে অনেক বছর লাগে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। মেগা প্রকল্প লাখ লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। 

গত এক যুগে বর্তমান সরকার সড়ক-মহাসড়ক, সেতু, রেলযোগ, বিদ্যুৎ, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, প্রতিরক্ষা, ডেল্টা প্ল্যান, স্যাটেলাইট, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মেগা বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছে। সরকারের মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের তালিকায় অন্যতম হলো পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলযোগ, পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ ইত্যাদি। 

কিন্তু এত সব প্রকল্পের অর্থনৈতিক তাৎপর্য, তাত্ত্বিক দিক কী? কেনই বা মেগা প্রকল্পে সরকারের এত আগ্রহ? সরকারি এসব প্রকল্প বিনিয়োগের আলোচনায় খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রোজেন্সটাইন রোডেনের ‘‌বিগ পুশ তত্ত্ব’ রয়েছে। তার তত্ত্বের বক্তব্য হলো, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে অর্থনৈতিকভাবে বড় ধাক্কার প্রয়োজন হয়। একটি বিমান যেমন উড্ডয়নের আগে গতির সঞ্চার করে, ঠিক সে রকম। অর্থাৎ অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশকে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হলে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। তিনি মনে করেন, ছোট আকারের বিনিয়োগ বাড়িয়ে মাথাপিছু আয় ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা যায় না। বরং বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। এতে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হন। 

বিগ পুশ বা বৃহৎ ধাক্কা তত্ত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিষ্কারভাবে বলা যায়— রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে সরকার এটি তত্ত্বাবধান করে, ভৌত অবকাঠামো বাস্তবায়নে ব্যয় বেশি হয়, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ বাজার সম্প্রসারণ হয়, অর্থনৈতিক মিতব্যয়িতা তৈরি, উৎপাদন ও কর্মস্থান বৃদ্ধি পায় এবং বিদেশী ঋণের প্রয়োজন পড়ে।

তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন সরকারগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। মেগা প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী ও দৃশ্যমান বলে সরকারগুলো ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে এসব প্রকল্পে আগ্রহ দেখান। নির্বাচনী মাঠে এগিয়ে থাকতে ও জনতুষ্টির জন্য এসব উন্নয়ন তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে আসছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আংশিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সরকার একের পর এক মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করছে। ১১ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‌অসমাপ্ত উন্নয়নকাজ শেষ করার জন্য আবারো নৌকায় ভোট চাই।’ অর্থাৎ উন্নয়ন প্রকল্প সরকারের অবদান ও গুরুত্ব তুলে ধরতে ভূমিকা রাখে। ভোটের আগে বর্তমান সরকারের শেষ একনেক বৈঠকে (৯ নভেম্বর) মোট ৩৯ হাজার ৯৪ কোটি টাকার রেকর্ড ৪৪টি প্রকল্প পাস হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য বিদেশী ঋণও রয়েছে। এটি স্পষ্ট যে অর্থনৈতিক সংকটের এ সময় প্রকল্প পাসের পেছনে নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একনেক বৈঠকে ৩৮টি প্রকল্প পাস হয়েছিল। 

বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে মেগা প্রকল্পের তাৎপর্য নিশ্চয়ই অনেক। উন্নত দেশে অনেক বড় অবকাঠামো থাকলেও ব্যবহারের লোক নেই। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ভর্তুকি দিয়ে চলে। প্রকল্প পরিচালনার জন্য যথেষ্ট লোকবল পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু ও মেরিন ড্রাইভ সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

বহির্বিশ্বে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ, হংকংয়ের পাতালরেল, সিঙ্গাপুরের বন্দর সুবিধা, দুবাইয়ের ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। দেশে পরিকল্পনার গলদ, বানোয়াট খরচ, নীতির দুর্বলতা, প্রযুক্তির স্বল্প জ্ঞান, সময়ক্ষেপণ, রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ও টেকনিক্যাল লোকের অভাবে মেগা প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। দেখা যায় প্রকল্প পাস হয়ে পড়ে থাকে, এরপর কাজ শুরু হয়, কিছুক্ষেত্রে নতুন করে পরিকল্পনা করা হয়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ে, একই সঙ্গে বাড়তে থাকে বাজেট।

তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। সে সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত হিসেবে উত্তরা-কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় বেড়ে গেছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বা ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ। মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আবার, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নে গেছে সাত বছর, ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধন করা হয়। সে সময় প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে, তবে মিয়ানমারের কারণে ঘুনধুম পর্যন্ত যায়নি রেলপথ। 

বিদেশে প্রকল্প পাসের আগে পরিকল্পনাটা ঠিকমতো করা হয়। চীন, জাপানের মতো দেশ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগে ৮-১০ বছর শুধু পরিকল্পনাই করে। এরপর তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেখা যায় বাস্তবচিত্র ভিন্ন। আসল উদ্দেশ্যই পূরণ হয়নি। প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা সবার কাছে পৌঁছায় না। গত ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চালুর ২৮ দিনে দেখা গেছে, মোট গাড়ির ৯৯ শতাংশই ছিল প্রাইভেট কার। সাধারণ মানুষ, গণপরিবহন সেখানে উঠছে না। অথচ বিপুল ব্যয়ে এ এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানীর যানজট কমার আশায় তৈরি করা হয়েছে। উল্টো এক্সপ্রেসওয়ের কারণে কোনো কোনো স্থানে যানজট বেড়েছে (আজকের পত্রিকা, ২ অক্টোবর, ২০২৩)। আবার, মেগা সিটি ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় সরকার যত বিনিয়োগ করেছে, তার মাত্র দশমিক ২৪ শতাংশ পথচারী অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ করা হয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। 

দেশের অগ্রগতি, মাথাপিছু জিডিপির প্রসারে রোজেস্টাইন রোডেনের বিগ পুশ তত্ত্ব উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু তার এ তত্ত্বের ‘‌সীমাবদ্ধতাগুলো’ সরকারকে আমলে নীতি হবে। রোডেনের তত্ত্বে অবকাঠামো, শিল্প ও মাথাপিছু আয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আলোচনায় আসেনি সুশাসন, কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, মূল্যস্ফীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বিদেশী অর্থনেতিক উন্নয়ন অর্থায়ন। 

অতি মেগা প্রকল্প ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে দৃষ্টি দিতে গিয়ে দেশের কৃষি খাতে সরকারের নজর কম পড়ছে। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কৃষক। অবাক করার বিষয়, একনেকের শেষ বৈঠকে কৃষি খাতের একটি প্রকল্পও নেই। সরকার মেগা প্রকল্প নিয়ে যতই আত্মতুষ্টিতে থাকুক না কেন, আপাতত দেশের রিজার্ভ, তারল্য, বৈদেশিক ঋণ ও মূল্যস্ফীতির কারণে আত্মতুষ্টিতে থাকার কারণ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশের ওপর।

এদিকে গত ২৬ অক্টোবর বণিক বার্তার দ্বিতীয় লিড স্টোরিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৭৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলো। সরকার অন্যান্য মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছে। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এসেছে রাশিয়া থেকে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা ভারত থেকে নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা মূল্যের ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে।

বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি পুঁজি পাচারের ঘটনা তো রয়েছেই। দেশের উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছা নিশ্চয়ই আছে। পাশাপাশি উন্নয়নের এ বড় ধাক্কা জনগণের ওপর যেন না আসে, সেদিকে সরকারকেই সামাল দিতে হবে। যদিও মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকারকে জনস্বার্থে পরিমাণগত প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে সমন্বিত ও গুণগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থনৈতিক নীতি ঠিক রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নে দূরদর্শী, মিতব্যয়ী, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ হতে হবে এবং গোষ্ঠীস্বার্থ এড়িয়ে চলতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা, পেশাদার প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারণ মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া কোনো অবকাঠামোই যথাযথ কাজে আসবে না। 

পাপলু রহমান: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন