ঘোষণা ছিল আলুর উদ্বৃত্ত ও রফতানির, এখন সিদ্ধান্ত আমদানির

অনুমতির দেড় মাসেও শুরু হয়নি ডিম আমদানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে আলুর উৎপাদন হয় চাহিদার চেয়ে বেশি। উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সুবিধা নিতে কৃষিপণ্যটির রফতানি বাড়াতে এখন পর্যন্ত নানা উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। যদিও দেশের বাজারেই পণ্যটির সরবরাহ এখন চাহিদার চেয়ে কম। অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আলুর বাজারদর। সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয়াসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। খোদ কৃষি খাতের নীতিনির্ধারকরাই এজন্য দায়ী করছেন হিমাগার মালিকদের সিন্ডিকেটকে। এ অবস্থায় বাজারে আলু সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে গতকালই কৃষিপণ্যটি আমদানির সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাজার স্থিতিশীলতা ফেরাতে আলুর মতো ডিমও আমদানির ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এজন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে গড়ে ১ কোটি করে আমদানির অনুমতিও দেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর দেড় মাস পার হলেও এখনো ডিম আমদানি শুরু করা যায়নি। আমদানিকারকরা বলছেন, ৩৩ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে আমদানি করতে গেলে তারা লোকসানে পড়বেন। আমদানি শুরু না হওয়ায় এখনো স্থিতিশীলতা ফেরানো যায়নি ডিমের বাজারে। 

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এখন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও তা বিক্রি হয়েছিল ৪৮-৫০ টাকায়। সে হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে কৃষিপণ্যটির দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর খুচরা পর্যায়ে আলুর সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে সময় বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৪৩-৫০ টাকা। 

এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আলু আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। যদিও বিভিন্ন সময় পণ্যটির রফতানি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন কৃষি খাতের নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল আলু রফতানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে কৃষি মন্ত্রণালয়। সে অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাশিয়ায় আগামী বছর দেড়-দুই লাখ টন আলু রফতানি হবে। বর্তমানে বছরে এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন বছরে ৮০ লাখ টন, বাকি ২০ লাখ টন রফতানির সুযোগ রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।’

দেশে আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি হিসাবে নিলেও প্রায় ১৫-২০ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৪২ টন আলু উৎপাদন হয়।

উৎপাদন বাড়লেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের আলু রফতানি কমেছে আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫৯ শতাংশ। মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৯১০ টন আলু রফতানি হয়েছিল। ২০২২-২৩-এ তা কমে নেমে আসে ৩২ হাজার ৩৯২ টনে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৬৮ হাজার ৭৭৩ টন।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রতি বছর আলুর দাম নিয়ে কারসাজি হয় মূলত হিমাগার পর্যায়ে। এতে ভূমিকা রাখেন ফড়িয়া, হিমাগার (কোল্ডস্টোরেজ) মালিক ও আড়তদাররা। উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে খুব অল্প দামেই পেঁয়াজ ও আলু কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ মার্চে কৃষক প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছিলেন ১০-১২ টাকায়, কিন্তু জুলাই থেকে অস্থির হওয়া শুরু করে পণ্যটির বাজারদর। 

কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। সচিবালয়ে গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আলুর যে দাম স্থির করে দিয়েছিলাম, এতে তাদের লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু সে দামের ধারেকাছেও তারা থাকছে না। আড়ত ও কোল্ডস্টোরেজগুলো মিলে দাম বাড়াচ্ছে। দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আলু আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। দেশে আলুর উৎপাদন বেড়েছে প্রচুর। আমরা বলি আলু উদ্বৃত্ত থাকে। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও উন্নত জাত প্রবর্তনের কারণে উৎপাদন বেড়েছে। আবহাওয়া আলু উৎপাদনের অনুকূলে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে আলু রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’ 

মন্ত্রী বলেন, ‘‌বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে; কিন্তু পরিস্থিতি এমন, কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা আলু বের করেন না। তারা আলু লুকিয়ে রাখেন। আজ থেকেই আইপিও ইস্যু শুরু হবে। আমদানির সিদ্ধান্তে দাম কমবে, মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে।’ 

আলু আমদানির এ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আলু আমদানির সিদ্ধান্তটি খুব বেশি কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নতুন আলু আসবে। অনেকেই বলছেন, এবার আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। তবুও আলু উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান তাতে ১০-১৫ লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ রফতানি হয়েছে মাত্র ৩২ হাজার টন। হিমাগার পর্যায়ে আলুর সিন্ডিকেট হয় কিন্তু সে সিন্ডিকেট ভাঙতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বাজারে আলুর সরবরাহ কম বলেই আলুর দাম বেড়েছে, ফলে আমদানি করতে হচ্ছে। উৎপাদন মৌসুমে আলুর দাম প্রতি কেজি ১০-১২ টাকা থাকে। সরকারের উচিত ছিল চাল ও গমের মতো কিছু পরিমাণ আলু উৎপাদন মৌসুমে কিনে হিমাগারে মজুদ রাখা। তাহলে যখন সংকট তৈরি হবে, তখন বাজারে ছেড়ে দিলে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কৃষকও ভালো দাম পাবেন।’

আলুর সরবরাহ কিছুটা কম থাকায় দাম বাড়ছে জানিয়ে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারিভাবে আলু উৎপাদনের যে তথ্য তার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের মিল নেই। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ‘‌১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, হিমাগারে ২৫ লাখ টন আলু মজুদ হয়েছে। বাকি ৮০ লাখ টন কি মার্চ-জুনের মধ্যে খাওয়া হয়ে গেল? এখানে কিছুটা গ্যাপ রয়েছে। এ বছর আলু কিছুটা কম রয়েছে। এ কারণে হিমাগার থেকে ব্যবসায়ীরা ধীরে আলু ছাড়ছেন। ডলারের যে সংকট রয়েছে তাতে আলুর আমদানি নিয়ে আমি সন্দিহান।’ 

এর আগে দেশের বাজারে ডিমের দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর তিন দফায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। তবে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেলেও কোনো ডিম আমদানি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিম আমদানিতে ৩৩ শতাংশ শুল্ক পরিশোধের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে লোকসানের শঙ্কায় তারা ডিম আমদানি করছেন না। ডিম আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩৩ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ডিম আমদানি করলে প্রতিটি ডিমের আমদানি খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা। 

আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠান মীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইয়ার হোসেন গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌প্রথম দিকে আইপি নিয়ে জটিলতা ছিল। এ কারণে আমদানি করতে পারছিলাম না। পরে পাঁচ লাখ টনের এলসি খুলেছি। আমাদের আমদানির উদ্দেশ্য দেশের বাজারে ডিমের দাম স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু লোকসান দিয়ে কেউ তো ডিম আমদানি করবেন না। যদিও আমার প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ডিম আমদানি করব। আগামী সপ্তাহে ডিম আসতে পারে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন