অভিমত

গণপরিবহনে নারীর ভোগান্তি

ফারিন জাহান সিগমা

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর আর্থসামাজিক অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। শিক্ষিত নারীর হার যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশের নারী কর্মজীবীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মজীবী নারীর পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও নারীরা এখন ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি পরিবহন সুবিধা। বাড়েনি নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যাও, একটি বাসে নারীদের সর্বোচ্চ বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা থাকে ১২টি। বাকি সব আসন থাকে পুরুষদের জন্য। অনেকে ক্ষেত্রে নারীদের দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আবার অনেক সময় বসার আসন না থাকলে বা রাত একটু বেশি হলে গণপরিবহনে নারীদের তোলা হয় না। আর বাসে নারীদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে কারণে বাইরে কাজ করা থেকে অনেক নারী আগ্রহ হারাচ্ছেন।

নারীদের জন্য বর্তমানে কোনো আলাদা বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা নেই। এছাড়া যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছে, অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই নারীদের পরিবহন সুবিধা দেয়া হয় না। বেশির ভাগ নারীদের পাবলিক সার্ভিস বা গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা বেশ কষ্টসাধ্য ও অনেকের কাছে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের এ ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেই চলাফেরা করতে হচ্ছে। 

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ৪১-৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশির ভাগ নারী, যার হার ৬৬ শতাংশ। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারী বলেছে, তারা চুপ থাকে এবং ৭৯ শতাংশ বলেছে আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যায়। বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহনসংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী।

আবার আরেক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের এক জরিপ বলছে, তাদের জরিপে অংশ নেয়া নারীদের ৮৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা জনসমাগমস্থলে অশালীন মন্তব্য শুনেছে এবং পুরুষরা যৌন হয়রানি করার সুযোগ খুঁজেছিল। অর্ধেকের বেশি নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

আবার কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সবচেয়ে বেশি, ৮৭ শতাংশ।

আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোয় ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৪ শতাংশ ছাত্রী।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গণপরিবহন ব্যবহার করেন। ওই জরিপে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যাত্রী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন। 

নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসে নয়টি আসন সংরক্ষিত রাখার নিয়ম রয়েছে। তবে সেই আসনগুলো থাকে চালকের আসনের কাছাকাছি। অনেক বাসে ইঞ্জিনের ওপর নারীদের বসার ব্যবস্থা রাখা হয়। সেই বরাদ্দকৃত আসনগুলোও অনেক সময় পুরুষদের দখলে থাকে। তাছাড়া ইঞ্জিনের গরমে পা রাখা বা বসে থাকা কষ্টকর ব্যাপার। 

তবে নারীদের জন্য কয়েকবারই আলাদা বাস সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিস চালু করা হয়। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এ সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। 

সর্বশেষ ২০১৮ সালে বিআরটিসির পাশাপাশি পরিবহন সংস্থা দোলনচাঁপা মিরপুর-১২ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রথম বেসরকারিভাবে নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু করে। এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালে ‘দোলনচাঁপা’ বাসের সংখ্যা দাঁড়ায় চারটিতে। তবে রাজধানীতে ‘দোলনচাঁপা’ বাস এখন আর দেখা যায় না। কবে থেকে কেন এ বাস বন্ধ হয়ে গেছে সে সম্পর্কে কেউ জানে না।

এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে নারীদের যাতায়াত সমস্যা দূর করতে আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা। বাসে সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর জন্য নাগরিকদের সচেতনতা প্রয়োজন। এছাড়া নারীদেরও নিজের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে।

সম্প্রতি ফেনীতে প্রথমবারের মতো নারীদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করেছে ফেনী পৌরসভা। এ রকম উদ্যোগ অন্যান্য জেলায়ও বিস্তৃত হোক, আমরা সে প্রত্যাশা করি।

ফারিন জাহান সিগমা: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন