এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন কমেছে

১৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন নগদ উত্তোলন চলতি বছরের জুলাইয়ে

হাছান আদনান

দেশের ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথ থেকে নগদ টাকা উত্তোলন অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে গ্রাহকরা বুথ থেকে ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করেছেন, যা গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুনে এটিএম বুথ থেকে ৪৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। সে হিসাবে, এক মাসের ব্যবধানে নগদ উত্তোলন প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। শুধু এটিএম বুথ থেকে নগদ উত্তোলনই নয়, বরং জুলাইয়ে দেশের পেমেন্ট ব্যবস্থার বেশির ভাগ মাধ্যমেই লেনদেন কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য  উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রতিটি পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে মানুষের সঞ্চয়ে। সঞ্চয় না থাকায় সাধারণ মানুষ ভোগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে বিপণি বিতানসহ রিটেইল বাজারে পণ্য বিক্রিও কমে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণেই এটিএম বুথের লেনদেন নিম্নমুখী। তবে ব্যাংক নিয়ে আস্থার সংকটের কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে বেশি রাখছে। বুথ থেকে টাকা উত্তোলন কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটিরও ভূমিকা রয়েছে।

দেশে ব্যাংক লেনদেনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ‘ডেবিট কার্ড’। চলতি বছরের জুলাই শেষে ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫০৭টিতে গিয়ে ঠেকেছে। অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম বুথ থেকে যেকোনো মুহূর্তে নগদ টাকা উত্তোলনের জন্যই এ কার্ডটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে কিছু গ্রাহক দেশ-বিদেশ থেকে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাইয়ে এটিএম বুথ থেকে যে পরিমাণ নগদ অর্থ উত্তোলন হয়েছে, সেটি ২০২১ সালের মে মাসের পর সর্বনিম্ন। চলতি বছরের জুনে এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকরা ৪৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা উত্তোলন করেছিলেন। জুলাইয়ে বুথ থেকে উত্তোলনকৃত অর্থের পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে যথাক্রমে ৪২ হাজার ৩৯২ কোটি ও ৩৭ হাজার ৬১১ কোটি টাকা উত্তোলন করেন গ্রাহকরা। শুধু নগদ উত্তোলনই নয়, জুলাইয়ে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটাও (পিওএস) কমেছে। জুনে পিওএস মেশিনের মাধ্যমে এ কার্ডে কেনাকাটা হয়েছে ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। জুলাইয়ে সেটি ৯৫৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে দেশে-বিদেশে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে জুনে লেনদেন ছিল ৪৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। জুলাইয়ে এ লেনদেন ৩৪ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকায় নেমেছে।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় কার্ডভিত্তিক লেনদেন কমে গেছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ কারণে সীমিত আয়ের মানুষের হাতে কোনো সঞ্চয় থাকছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব ধরনের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। দেশের বিপণি বিতানসহ খুচরা বেচাকেনার (রিটেইল সেল) পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় আমাদের গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়েও চাপে আছেন।’

দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্ডভিত্তিক লেনদেন হয় ‘ক্রেডিট কার্ড’-এর মাধ্যমে। ডলার সংকটের কারণে এ কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে কেনাকাটা বেড়েছে। এ কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এ কার্ডে লেনদেন কমলেও সামগ্রিকভাবে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন সামান্য বেড়েছে। জুনে ক্রেডিট কার্ডে মোট লেনদেন ছিল ২ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। জুলাইয়ে এসে এ লেনদেন ২ হাজার ৬৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক সংখ্যা ২২ লাখ ৬৮ হাজার ৩৭১। এসব গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের ৯ হাজার ৯৫ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি রয়েছে।

তৎক্ষণাৎ লেনদেনের জন্য দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে ক্রমাগত বেড়েছে। তবে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে এ দুটি মাধ্যমেই অর্থ লেনদেন কমে গেছে। এ মাসে এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৯৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। তবে জুলাই ছাড়া ফেব্রুয়ারির পর কোনো মাসেই এমএফএসের লেনদেন ১ লাখ কোটি টাকার নিচে নামেনি। চলতি বছরের জুনেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। বর্তমানে দেশে এমএফএস হিসাবধারীর সংখ্যা ২০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৩৪।

চলতি বছরের জুনে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার করে ৪৯ হাজার ৯৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ে ইন্টারনেট-ভিত্তিক এ লেনদেন ৪৬ হাজার ২৪৩ কোটিতে নেমে আসে। জুলাইয়ে ব্যাংকিংয়ের প্রধানতম উপকরণ ‘চেক’-এর মাধ্যমে লেনদেনও কমেছে। একই সঙ্গে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি), এজেন্ট ব্যাংকিংসহ অন্যান্য লেনদেন ব্যবস্থায়ও অর্থ উত্তোলন ও জমা কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, গত দুই বছর দেশের কোনো না কোনো ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ কারণে অনেক গ্রাহকই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে নগদে সংরক্ষণ করছেন। ব্যাংকে অর্থ লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে আস্থার ঘাটতিরও ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। দেশের ব্যাংকগুলোয় নগদ টাকার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক গত তিন বছরে বিপুল পরিমাণ নতুন নোট ছাপিয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকাই ছিল ব্যাংকের বাইরে। ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ অর্থ ছিল ২০ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

দেশের ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা পাওয়া যাচ্ছে না বলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের গ্রাহক মোসাদ্দেক হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার ফেনী শহরে পাঁচটি ব্যাংকের এটিএম বুথ ঘুরেও টাকা পাননি। বেশির ভাগ এটিএম বুথ ছিল নষ্ট কিংবা নেটওয়ার্ক সমস্যাগ্রস্ত। দুটি এটিএম সচল থাকলেও সেগুলোয় টাকা ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন এটিএম বুথে একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে চতুর্থ প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ‘অনেক ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। এ কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেও তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো এটিএম বুথ অচল করে রেখেছে।’

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এখন দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সরবরাহ কম। আমানতের প্রবৃদ্ধি দেখলেই সেটি দৃশ্যমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, এটি সত্য। কিন্তু সব ধরনের লেনদেন কমে যাওয়াটি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঈদসহ যেকোনো উৎসবের সময় দেশে লেনদেন বাড়ে। লেনদেন কমে যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করতে হলে আমাদের আরো দুই-তিন মাসের চিত্র দেখতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন