ব্যাংক ঋণ

বড়রা লুট করলেও কৃষকরা ফেরত দিচ্ছেন

হাছান আদনান

দেশের ব্যাংক ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই বড় শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি প্রায় একই। ব্যাংকের খেলাপ হওয়া ঋণের সিংহভাগই বড় গ্রাহকদের নেয়া। খেলাপি এসব বড় গ্রাহক ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলেও আইনি প্রক্রিয়ারও বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেশের কৃষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের কৃষকরা ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছেন, সুদসহ তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করছেন। 

দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) কৃষকরা ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বিপরীতে তারা পরিশোধ করেছেন ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর আগেও কৃষকরা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেছেন। এমনকি কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে আদায় হয়েছে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ওই বছর কৃষকরা ২৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করেছেন।

যদিও ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যাচ্ছে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ করেছিল ৭২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় করতে পেরেছিল ৬৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের শিল্প ঋণ বিতরণ ও আদায়ের চূড়ান্ত হিসাব এখনো প্রকাশ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও এ খাতে বিতরণের চেয়ে আদায় কম হয়েছে। এর আগের পাঁচ অর্থবছরের তথ্য পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, প্রতিবারই ব্যাংকগুলো শিল্প খাতে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে, আদায় হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা ছিল কৃষি খাতে। সে হিসাবে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে কৃষকরা পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ এখন খেলাপি। যদিও দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের খাতভিত্তিক গড় খেলাপির হার ৯ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ব্যাংকের ঋণ খেলাপের সংস্কৃতির মধ্যেও কৃষকরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন। প্রকৃত কৃষকরা কখনই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হন না। করোনার সময় নীতি ছাড়ের মধ্যেও তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। অন্যদিকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বড় বড় শিল্প গ্রুপ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।

যেসব বড় ঋণগ্রহীতার ‘মাসল পাওয়ার’ বেশি, মূলত তারাই ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না বলে অভিমত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘‌কৃষিসহ ছোট ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বেশ ভালো থাকে। এ শ্রেণীর গ্রাহকরা কথা শোনে। তারা মামলাকে বেশ ভয় পায়। নিজের ও পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই ভিন্ন। দেশের বড় গ্রাহকদের “‍মাসল পাওয়ার’’ বেশি। দেশের ব্যাংক খাতে যেসব বড় ঋণ খেলাপি হয়েছে, কিংবা যেসব ঋণ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিতরণ হয়নি। কোনো না কোনো সম্পর্ক কিংবা প্রভাবের কারণেই তারা ঋণ পেয়েছেন। পেশিশক্তির জোর বেশি এমন গ্রাহকরা আইন-আদালতকে তোয়াক্কা করেন না। এ কারণে বড় গ্রাহকদের বিরুদ্ধে মামলা করেও ঋণ আদায়ের নজির খুব কম। জামানত যথাযথ থাকলে তবেই কিছু ঋণ আদায় হয়। জামানতের সম্পত্তি ঠিক না থাকলে বড়রা ঋণ পরিশোধের চিন্তাও করে না।’

দেশের কৃষকদের দেয়া ঋণ সুবিধার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিওর মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে ২৫-৩০ শতাংশে। প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০-৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দ্বিগুণ-তিন গুণ সুদে বিতরণ করছে।

কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণের ৪৪ শতাংশ গিয়েছে শস্য উৎপাদনে। ২২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রিতে এবং ১২ দশমিক ৮ শতাংশ মৎস্য খাতে বিতরণ হয়েছে। বাকি ঋণ গেছে কৃষির অন্যান্য খাতে। মোট কৃষি ঋণের ৫৭ শতাংশ বিতরণ করেছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ শতাংশ ঋণ।

দেশের কৃষি খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ দিয়েছে দুই ব্যাংক—বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বিশেষায়িত এ দুটি ব্যাংক কৃষকদের মধ্যে সরাসরি ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ। আর রাকাবের খেলাপি ঋণের হার ১৬ শতাংশের বেশি।

সরকারি এ ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা বলছেন, গত দেড় দশকে বিকেবি ও রাকাবের বড় কিছু ঋণ প্রভাবশালীরা বাগিয়ে নিয়েছেন। এসব ঋণ বাদ দিলে কৃষকের দেয়া ঋণে খেলাপির হার ৫ শতাংশেরও কম। আবার ব্যাংক দুটির কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধেও কৃষকদের নামে ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত কৃষকরা ব্যাংক ঋণের শতভাগই ফেরত দিচ্ছেন।

ছোট ঋণের গ্রহীতাদের মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার সংস্কৃতি বেশ ভালো বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমি সবসময়ই দেখেছি কৃষকসহ ছোট উদ্যোক্তারা ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে উদগ্রীব থাকেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ খেলাপি হন। আমাদের কৃষক ও ছোট ঋণগ্রহীতারা আইন-আদালতকে ভয়ের পাশাপাশি সম্মানও করেন। কিন্তু বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে এর যথেষ্ট ঘাটতি আছে।’ 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ‘‌এক দশক আগে কৃষি ব্যাংক বড় কিছু ঋণ বিতরণ করেছিল। সেগুলো আর ফেরত আসেনি। খেলাপি হওয়া প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বড় ঋণ বাদ দিলে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের নিচে থাকত। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও সিএসএমই খাতের জন্য বেশকিছু পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। ফলে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এ খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহী হয়েছে। আশা করছি, পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে দেশের কৃষক ও প্রান্তিক ছোট উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন।’

গ্রামীণ ব্যাংকসহ দেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিও থেকে কৃষকরা ঋণ বেশি নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ‘চলতি বছরের জুনে গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০টি এনজিও ১৬ হাজার ৮৬১ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করেছে ১৬ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ১ লাখ ১২ হাজার ৮৬২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সারা দেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০টি এনজিওর সদস্যসংখ্যা ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬০ হাজার। মোট ১২ হাজার ৯৬৪টি শাখার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসব প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট খেলাপি ঋণের ৫৫ শতাংশই উৎপাদনশীল শিল্প খাতের। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ খাত। এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশই এখন খেলাপি। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতে খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ১২ শতাংশ, বস্ত্র খাতে ১১ দশমিক ৫৪ ও চামড়া শিল্পের ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি। দেশের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে কৃষি খাতের অংশ মাত্র ২ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন