পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি তিন শিক্ষকে একজন অধ্যাপক!

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বৈশ্বিক মান নিশ্চিত করা জরুরি

জনগণ বা পাবলিকের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য জনগণের প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়ও অনেক। কোনো দেশের বিদ্যমান সমস্যার কারণ অনুসন্ধান ও তার সমাধানের পথ বাতলে দেয়ার দায় রয়েছে তাদের। সুশিক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে দক্ষ মানবশক্তি বিকাশ ও গবেষণার মাধ্যমে অগ্রসর অর্থনীতির পাটাতন তৈরি করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের ভূমিকা অসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সে রকম না হলেও একজন ভালো শিক্ষক যে বিশ্বসেরা ছাত্র উপহার দিতে পারেন তার উদাহরণ ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক থাকেন সবার ওপরে। তারা যেমন শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে সহায়কের ভূমিকা পালন করেন, তেমনি নবীন শিক্ষককে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। এজন্য অধ্যাপক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু যদি প্রয়োজনীয় গবেষণা ও পাঠদানে অসাধারণত্ব অর্জন ছাড়া কেউ অধ্যাপক পদ বাগিয়ে নেন তাহলে তা শিক্ষার জন্য মঙ্গলজনক কিছু না হয়ে শুভংকরের ফাঁকি হিসেবেই দেখা দিতে পারে। 

গতকাল বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‌পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি তিন শিক্ষকে একজন অধ্যাপক!’ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৬। তাদের মধ্যে অধ্যাপক আছেন ৪ হাজার ৬৬১ জন। সে হিসেবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ৩০ দশমিক ৫৯ শতাংশই অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই অধ্যাপক হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশে তেমন একটা দেখা যায় না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বা সমতুল্য কোনো পদে যোগদানের পর প্রতিটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপীই কিছু মান অনুসরণ করা হয়। নির্দিষ্টসংখ্যক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা বা জার্নালে গবেষণাভিত্তিক মানসম্মত নিবন্ধ প্রকাশ করতে হয়, যার গ্রহণযোগ্য রিভিউ বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরই একেকটি পদোন্নতির সুযোগ পান তারা। আবার কোনো কোনো দেশে পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না। মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষকদের নিয়মিত জ্ঞানচর্চা নিশ্চিতে দেয়া এসব শর্ত পূরণ করে অধিকাংশেরই অধ্যাপক হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন। নির্দিষ্ট সময়সীমা পার করতে পারলেই পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। আবার এক্ষেত্রেও জ্ঞানচর্চা বা গবেষণার মানের পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনাসহ অন্যান্য ইস্যু প্রাধান্য পায় বেশি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে দিন দিন গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে তাতে এ বিষয়টির বড় ভূমিকা রয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২১ এবং বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অধ্যাপক। সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক আছেন যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৩৭ ও ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। প্রভাষক আছেন মাত্র ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ প্রভাষকদের বেশির ভাগই আবার নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রভাষকের হার তুলনামূলক অনেক কম। বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনুষদও আছে, যেখানে শিক্ষকদের সবাই অধ্যাপক। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা এখন এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৩১১ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক ৮৪১ জন বা ৩৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অধ্যাপকের সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা কার্যক্রম দিন দিন কমে আসছে। কমছে গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণও। বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কয়েকটি গবেষণাগার এখন অর্থাভাবে বন্ধ রয়েছে। কিছু গবেষণাগারে অর্থ বরাদ্দ হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মাস্টার্স পাস করার পরের বছরই শিক্ষক হওয়া যায়। কিন্তু বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি শেষ না করে শিক্ষকতা শুরু করা যায় না। সেখানেও প্রভাষক পদ আছে। কিন্তু সেগুলো সাধারণত খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু যারা সার্বক্ষণিক শিক্ষক, বিশেষ করে যারা গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ান, তারা সাধারণত পিএইচডি শেষ করার পর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা জীবন শুরু করেন। সে সময় প্রতি বছরই তাকে নিজ বিভাগ, অনুষদ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েক ধাপে মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমাদের এখানে চিত্রটি ভিন্ন। এর পেছনে অন্যতম দুটি কারণ হলো, সবাইকে তুষ্ট করার প্রবণতা এবং অধ্যাপক পদের সঙ্গে বেতন কাঠামোর সম্পর্ক। 

অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া সহজ হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণায় উৎসাহ কমেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য হলো শিক্ষকদের মধ্যে উৎসাহ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন গবেষণায় বরাদ্দ কমিয়ে অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করছে বেশি। জ্ঞান সৃষ্টিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন অবদান রাখছে, তার বড় একটি মাপকাঠি হলো গবেষণা। কিন্তু এখন সেদিকে নজর কম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এ কারণে বিশ্বের শীর্ষ হাজার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় না।

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। এখন আমরা কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় করতেই পারি। সামনের দশকগুলোয় বাংলাদেশ অর্থনীতি ও রাজনীতির দিক থেকে আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গবেষণায় মনোযোগ দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দেশের প্রধান কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে রিসার্চ ফোকাসড প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নয়।

এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন জরুরি। বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ করে তা জানা কঠিন কিছু নয়। আমাদের বিশ্বমঞ্চে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়াতে হলে শিক্ষক নিয়োগের প্রাথমিক ধাপেই সর্বোত্তম প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটি সাধারণ চিত্র হচ্ছে শিক্ষক হওয়ার পর অনেকেই পড়াশোনা ও গবেষণা ছেড়ে দেন। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ও প্রমোশন কাঠামোর কারণে এমনটা হচ্ছে। কোনো বিভাগ বা ডিসিপ্লিনে অধ্যাপক হওয়ার জন্য বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ইউজিসিরও দায়িত্ব অনেক। উন্নয়নশীল থেকে উন্নত বিশ্বে পা দিতে গেলে প্রতিরক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো কিংবা তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষা খাতে। এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি অধ্যাপক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন