ভ্যাট ৫ শতাংশ রাখার জন্য প্রস্তাব রাখি

আমিনুল হক শামীম , ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বিকাশে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

বর্তমানে বাংলাদেশে পর্যটন খাত নিয়ে কী ধরনের কাজ করা যায় তা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৬ সালে পর্যটন বর্ষ ঘোষণার পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেসব নিয়ে কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। কিন্তু তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বরতরা সে নির্দেশনার ২০ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সামনে আমাদের বাজেট। এতে ঋণের সুদের পরিমাণ কিছু কমিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে করহার কিছু কমিয়ে দিলে খাতের জন্য সুবিধা হবে। বাংলাদেশে সাগর, পর্বত বনসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আছে। এগুলোর প্রচার উন্নয়ন করা পর্যটন শিল্পের জন্য দরকার। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যতবার বিদেশ সফরে গিয়েছি, ততবারই দেখেছি পর্যটন শিল্প নিয়ে কথা বলেছেন। আমাদের দূতাবাসগুলো পর্যটন মন্ত্রণালয় যদি উনার দিকনির্দেশনা মোতাবেক কাজ করত, তাহলে অবশ্যই পর্যটন খাত দেশের বড় একটি আয়ের উৎস হতো। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা কেন্দ্রস্থলে পরিণত হতো।

বাংলাদেশের পর্যটন খাত দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের জন্য কতটা প্রস্তুত হতে পেরেছে?

বিনিয়োগের পরিবেশের জন্য নিরাপত্তা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। ১০ বছরে সরকার পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করেছে। তাদের কার্যক্রমও বেশ লক্ষণীয়। আর যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বললে, কক্সবাজারে আমাদের আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর ছিল না, সেটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে, রেল যোগাযোগ উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটা সুন্দরবন সুফল পাচ্ছে। সরকারের দিক থেকে যা যা করা দরকার তা সরকার করছে। কিন্তু আমাদের বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারেরও উদ্যোক্তাদের গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।

ব্যাংকঋণ মূলধন জোগানের ক্ষেত্রে খাতে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খাতে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়া হয়। সেটি সাধারণত হয় পাঁচ বছরের জন্য। একটা বাড়ির জন্য ঋণ দেয়া হয় ১০-১৫ বছরের জন্য। আমরা আমাদের পর্যটন খাতকেও আবাসন খাতের মতো মনে করি। ফলে এখানে পাঁচ বছরের জন্য যেটা দেয়া হয় সেটি পরিশোধ করা কঠিন। এটিকে দীর্ঘমেয়াদি করার জন্য আমি সুপারিশ করছি। তাহলে পর্যটন খাতের উন্নয়ন হবে।

বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং আগের তুলনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার যে উন্নয়ন ঘটেছে দেশে, সেটি বিদেশীদের জানানোর জন্য প্রচারণার কাজটি কতটুকু হচ্ছে?

বিদেশী পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তার বিষয় বলতে গেলে -১০ বছরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কক্সবাজার বিচে ১০ বছরে কখনো ছিনতাই বা নিরাপত্তাহীনতা আমার চোখে পড়েনি। এখন শূন্য বলা চলে। পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক কিছু সমস্যা আছে। সেখানে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। আর কোথাও কোনো অসুবিধা দেখি না। স্থানীয় পর্যটকদেরও হয়রানির শিকার হতে এখন দেখি না তেমন একটা। নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রচার করতে হবে। আমাদের এখানে পর্যটনের কী কী আছে, সেটি নিয়ে দূতাবাসগুলোর কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার জন্য আরো অনেক প্রচারণা প্রয়োজন। এখানে আরো অনেক কাজের সুযোগ আছে, কাজ করতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয় আছে, ট্যুরিজম বোর্ড আছে উনারা যদি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করে, তাহলে আমরা খাতে অনেক সম্ভাবনার আশা রাখি।

সরকার এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে পর্যটনের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সরকার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি জোন তৈরির মাধ্যমেই যে পর্যটনের বিকাশ ঘটবে, এটার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। এখানে গ্যাস বা বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হবে। পর্যটন জোন বলতে আমাদের জায়গা তো বিশাল। তাই নির্দিষ্ট অঞ্চল করাটা আমি দ্বিমত পোষণ করি। যে জায়গাগুলো আমাদের আছে, সেগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়লে পর্যটক আকৃষ্ট হবে। নিজস্ব চিন্তাধারায়, নিজস্ব ভ্রমণ সুবিধাগুলো পাবে। যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতে চাচ্ছে সরকার, সেগুলো সব জায়গায় সব উদ্যোক্তাকে দেয়া হলে খাত অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে না।

সুনির্দিষ্ট করে যদি বলেন, তাহলে এবারের বাজেটে আপনারা কী কী দাবি জানিয়েছেন?

বাজেটে প্রতি বছর আমরা একটা প্রস্তাব দিই। আমাদের এখানে ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। এখানে ভ্যাট শতাংশ রাখার প্রস্তাব করি। পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্য অঞ্চলগুলোয় ট্যাক্সের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য একটা নীতিমালা চাই সরকারের কাছে।

বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে শুধু সরকার না, বেসরকারি খাত থেকেও উদ্যোগ প্রয়োজন। খাতে দক্ষ জনবল বা উদ্যোক্তা তৈরি করার ক্ষেত্রে কতটা ঘাটতি রয়েছে?

পর্যটন করপোরেশন দক্ষ কর্মী তৈরির চেষ্টা করছে। আমাদের কর্মীরা বিদেশে গিয়ে কাজ করে, কিন্তু দেশে সেটি পায় না। জায়গায় এখনো কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ আছে। এখানে একটা ঘাটতি রয়ে গেছে।

ইকো ট্যুরিজমের সম্ভাবনা বাংলাদেশে কতটুকু?

ইকো ট্যুরিজমের চাহিদা ব্যাপক। বাংলাদেশে এর অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এটা আমরা ভোগ করতে পারি না। পর্যটন শিল্পটাকে নিয়ন্ত্রণ কে করে, আমি খাতের একজন বড় উদ্যোক্তা হয়েও জানি না। এটা কি জেলা প্রশাসন করে নাকি বিডা করে, এটাকে একটা জবাবাদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দেখা যায় যে আমাদের একটা হোটেল করতে গেলে ১৫-১৬টা জায়গা থেকে অনুমতি নিতে হয়। একেকজনের একেক চিন্তাধারা। এটা কোনো নীতিমালার মধ্যে ফেলতে হবে। আমাকে জেলা প্রশাসনের কাছে এক রকম ব্যাখ্যা দিতে হবে, বিডাতে যেতে হবে, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা আছে। সেটি বাস্তবায়ন কে করবে? আমার মনে হয় এখানে একটা ঘাটতি আছে।

বাংলাদেশে বহু জাতি আছে, সব জাতির আলাদা সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতি পর্যটনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

এটা তো পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে। এটিকে ইকো ট্যুরিজমের একটা অংশ বলা যেতে পারে। আমি যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে করব, তখন তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে করা যেতে পারে। তাদের স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রমোট করা যেতে পারে। এতে স্থানীয়দের আয়েরও একটা উৎস হতে পারে। স্থানীয়রা যেটি উৎপাদন করে, সেটিকে প্রমোট করা যেতে পারে। এতে আমরা কিন্তু আমাদের স্থানীয় ঐতিহ্যকে দেশে বিদেশে প্রমোট করতে পারি। বান্দরবানে যদি আমরা কিছু করতে যাই, তাহলে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, অর্থায়নের মাধ্যমে আমরা যদি বলি তোমরা তোমাদের সংস্কৃতিটাকেই আরো সুন্দরভাবে তুলে ধরো, তাহলে কিন্তু ভালো হয়। যথেষ্ট প্রশিক্ষণ প্রণোদনা দেয়া হলে তারাও এগিয়ে আসবে।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের পর্যটন নিয়ে কী কী কাজ করতে পারি?

এক্ষেত্রে পর্যটনের ব্যাপক উন্নয়ন করা উচিত। আমি আগ্রহী ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বস্ত্র শিল্পের পরই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন পর্যটন শিল্পকে। সেজন্যই তিনি এটিকে প্রমোট করেন বিশ্বব্যপী। উনি জানেন, খাত জিডিপিতে একটা ভালো অবদান রাখতে পারে। আমরা বেসরকারি খাত যদি এগিয়ে আসি এবং সরকারের যারা আছেন তারা যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে জিডিপিতে একটা ভালো অবদান রাখতে পারবে খাত।

পর্যটনের জন্য ব্র্যান্ডিংয়ের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা সেটি কতটা করতে পেরেছি?

ব্র্যান্ডিং যেকোনো জিনিসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনারা দেখবেন বিভিন্ন চ্যানেলে মালয়েশিয়া ট্যুরিজম, থাই ট্যুরিজমের ব্র্যান্ডিং হয়। তারা পর্যটনের জন্য এত জনপ্রিয়, তার পরও ব্র্যান্ডিং করে যাচ্ছে। এটি করতেই হবে। আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ট্যুরিজম বোর্ড আছে, পর্যটন করপোরেশন আছে। ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমরা কিন্তু মানুষ যেখানে ভিসার জন্য যায়, সেখানে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বাংলাদেশের লিফলেট পোস্টার রাখতে পারি যে কোথায় কী আছে।

আপনি পাহাড়ের কথা বলছিলেন। আমাদের পাহাড়গুলোয় অনেক সুন্দর সুন্দর ঝরনা রয়েছে। উন্নয়ন করতে গিয়ে অবকাঠামো নির্মাণের সময় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এসব ঝরনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ইকো ট্যুরিজম সম্পর্ক যুক্ত। ধরনের প্রকল্পগুলো এমনভাবে করা উচিত, যাতে সম্পদগুলো সংরক্ষিত থাকে এবং ট্যুরিজমও বাড়ে

বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। খাত নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন?

আমাদের সি পার্ল বিচ অ্যান্ড রিসোর্ট যেটা করেছি, সেটার একটা স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা। বান্দরবান, সুন্দরবনে মানের হোটেল করলে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ আছে। এখানে বৈশ্বিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে হোটেলগুলো করতে হবে। যেখানে-সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো যদি হোটেল করি, তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটকরা সেখানে গিয়ে তাদের মানসিকতা কী হবে? যদিও পরিবেশটা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে এখন। বিদেশীরা এলে যেন তাদের মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে না যায়, আমাদের এখানে এমন উন্নয়ন করা উচিত। পর্যটন খাতে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব একটা সংস্থাকে দেয়া উচিত। যাতে উদ্যোক্তারা হয়রানির শিকার না হয়। আর না হলে পর্যটন খাত বাধাগ্রস্ত হতেই থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন