তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত, ফার্নিচার, এগ্রো-ফুড, চামড়া শিল্প, ফুটওয়্যার ও পর্যটন—চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে কর্মচ্যুতি বাড়বে দেশের এ ছয় শিল্প খাতে। শুধু তৈরি পোশাক খাতেই চাকরি হারাবেন ২৫ লাখ শ্রমিক, যার ৫০ শতাংশই অল্প শিক্ষিত নারী কর্মী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘লেবার
মার্কেট অ্যান্ড স্কিল গ্যাপ অ্যানালাইসিস ফর রেডি মেড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক শিল্প খাতে রফতানি না বাড়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা ‘লো-স্কিল ওয়ার্কার’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে এ খাতে অটোমেশন বাড়বে এবং নতুন নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। এতে অল্প দক্ষ শ্রমিকদের চাকরি হুমকির মুখে পড়বে।
রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত দুদিনব্যাপী ‘বিআইডিএস
রিসার্চ অ্যালমানাক ২০২৩’ শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী দিন গতকাল গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন হলো সবচেয়ে বড় বাজার। তবু তৈরি পোশাক শিল্প ও টেক্সটাইল খাতে সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন হবে যে পেশাগুলো সেগুলো হলো সিউইং মেশিন অপারেটর, ফ্লোর সুপারভাইজার, প্যাটার্ন মেকার, প্রোডাকশন প্ল্যানার, মার্চেন্ডাইজার, পোর্টফোলিও ডেভেলপার, ফ্যাশন ডিজাইনার।
গবেষণায় বলা হয়েছে, কিছু পেশা হুমকির মুখে পড়লেও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতার কদর বাড়বে। নতুন করে বেশকিছু পদ তৈরি হবে। কম্পিউটার এইডেড প্রসেস প্ল্যানিং প্রফেশনাল, কম্পিউটার এইডেড কোয়ালিটি কন্ট্রোল, অটোমেটেড ইন্সপেকশন, আর্টিফিশিয়াল নেটওয়ার্ক এক্সপার্ট, রোবট অপারেটর ইত্যাদি পদে দক্ষ কর্মীর চাহিদা থাকবে সবচেয়ে বেশি। আরেকটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গবেষকরা বলছেন, এ খাতে অদক্ষ শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন হোক সেটি উদ্যোক্তারা চান, কিন্তু তাদের জন্য প্রশিক্ষণে অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী নন তারা।
একাধিক উৎপাদন খাত ও শ্রমবাজার নিয়ে ‘স্কিল
গ্যাপ ইন দ্য অ্যাগ্রো ফুড প্রসেসিং সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ আরেকটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাতে কর্মীদের দুই ধরনের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের অভাব, খাদ্যনিরাপত্তা, স্যানিটেশন ও খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। সেই সঙ্গে যারা এ খাতে কাজ করছেন তাদের বিশেষায়িত ডিগ্রি না থাকায় যথোপযুক্ত দক্ষতার অভাব রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যসূত্রে গবেষণায় বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্পের পর প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদন খাত। উৎপাদন শিল্পের মোট ১২ দশমিক ২৬ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার পেশাজীবী এখানে যুক্ত। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বাংলাদেশ ১ হাজার ২৮ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলার রফতানি করে। যদি দক্ষতা বাড়ানো যায় তাহলে এ খাতেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। গবেষকরা বলছেন, মেশিন অপারেটর, ফুড টেকনোলজিস্ট, মিক্সারম্যান, কেমিস্ট, কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার, প্যাকেজিং সুপারভাইজার, ফুড প্রসেসিংয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমাধারীর অভাব রয়েছে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত খাতে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। মডারেটর ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। এছাড়া প্যানেলিস্ট ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসাইন, প্রফেশনাল ফেলো ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল প্রমুখ।
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘ভোগভিত্তিক
দারিদ্র্যের পরিমাপ কিছুটা বাড়লেও এখন নিম্ন পর্যায়ে আছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্র থেকে নানা সুবিধা দেয়ায় তাদের ভোগে অতটা চাপ পড়েনি।’
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘আমার
চারটি বার্তা। এর মধ্যে দুটো ইতিবাচক ও দুটো নেতিবাচক। ইতিবাচক হচ্ছে বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য দ্রুত কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের রেজিলিয়েন্স ক্যাপাসিটি অসাধারণ। সেটা কভিডের সময় আমরা দেখেছি। এছাড়া নেতিবাচক দুটো দিক হচ্ছে ড. জুলফিকার তার কাজে ৬৪ জেলার ৬২ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ করে দেখিয়েছেন যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ৫০ শতাংশ কমপ্লেক্স বাক্য পড়তে পারে না। আমাদের শিক্ষার এ সংকট দূর করতে হবে। এছাড়া আরবান ইনইকুয়ালিটি বাড়ছে। বৈষম্য কিন্তু সবসময় বাড়বে এটা অবধারিত না। আরবান ইনইকুয়ালিটি ৫০ থেকে ৫৪ শতাংশে গেছে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের
এডুকেশনাল ডেফিসিয়েন্সিটা সবেচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এটা অনেকভাবেই হচ্ছে। বাংলাদেশের লংটার্ম প্রসপেক্ট ও ডেভেলপমেন্ট সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে যাচ্ছে শিক্ষা খাতকে। আমাদের জনবহুল দেশে এখানে সবচেয়ে বড় সম্পদ জনগণ।’ অমর্ত্য সেনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা
দিয়ে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করা সম্ভব না। এটার জন্য জনমুখী আন্দোলনের দরকার।’ তিনি উদাহরণ হিসেবে কেরালা ও কিউবার কথা বলেন।
জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকারিভাবে
কেন এত উচ্চমূল্যে জমি কিনছি আমরা? এখানে দালালি ও অন্যান্য তত্পরতা চালিয়ে জমির দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারিভাবে পদক্ষেপ নিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ
কমছে, বিনিময়হার নিয়ে এখানো অনিশ্চয়তা কাজ করছে। বিনিময়হার ধরে রাখা সম্ভব হবে না যদি রিজার্ভ এভাবে কমে। এক বছর হয়ে গেল রিজার্ভ এখনো কমছে। এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।’