২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে পুঞ্জীভূত এফডিআই কমেছে ৫ শতাংশ

বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহের ছন্দপতন অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়

বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে ২০২২ সালের প্রথমার্ধেই সংকটের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এফডিআই প্রবাহও এ সময় নিম্নমুখী হয়। পাশাপাশি ঘটতে থাকে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘটনাও। কমে যায় বিদেশী বিনিয়োগের পুঞ্জীভূত পরিমাণ। এর আগে গত দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে এফডিআই স্টক ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে ওই ধারাবাহিকতা হারিয়ে এফডিআই প্রবাহে দেখা যাচ্ছে ছন্দপতন। টাকার মূল্য পতন, ডলার সংকট, পুঁজিবাজারে প্রাইস সিলিং, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশী বিনিয়োগ কমছে বলে বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত বছরের দুর্বিপাক শুরুর আগে থেকেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগের প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল, যা ২০২২ সালে বেড়ে ওঠে। সরকার যেখানে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে, লক্ষ্য এখন উন্নত দেশ হওয়ার। এ পথ পাড়ি দিতে হলে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিদেশী বিনিয়োগ অর্থের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষও নিয়ে আসে। এমন প্রেক্ষাপটে পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ দ্রুত অনুসন্ধানপূর্বক তার সমাধান নিশ্চিত করা জরুরি। 

গত বছরের প্রথমার্ধে ইকুইটি মূলধন, পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ—এ তিন খাতেই দেশে এফডিআই স্টক কমেছে। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের মতো কমছে বিদেশী পোর্টফোলিও বিনিয়োগও। গত বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই বৈদেশিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ কমছে। এফডিআই স্টকের ক্ষেত্রে ইকুইটি মূলধন কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ আমাদের মূলধন হিসাবগুলো রূপান্তরযোগ্য নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বহুজাতিক কোনো কোম্পানি তাদের বিনিয়োগের শেয়ার স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি না করে অথবা বড় পরিমাণে লোকসান না করে, ততক্ষণ এফডিআই স্টক কমার কথা না। আবার কোনো বিদেশী কোম্পানি বাইরের কোনো কোম্পানির কাছে শেয়ার বিক্রি করলেও স্টক কমার সুযোগ নেই। কারণ এতে যে পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাহার হবে, তার সমান আবার দেশে প্রবেশের কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। 

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে ছিল ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় মালয়েশিয়ার ইলেকট্রনিকস শিল্পের মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগ। ১৯৮০ সালে জাপানের বিনিয়োগের ফলে মালয়েশিয়ার শিল্প খাত বিকাশ লাভ করে এবং দেশটির লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল শিল্পোন্নত দেশ হওয়া। মালয়েশিয়ায় ‘প্রোটন’ ও ‘পেরোডুয়া’ নামক গাড়ি উৎপাদিত হচ্ছে এবং এই শিল্পে প্রায় ৭ লাখ লোক কর্মরত রয়েছে। দেশীয় ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত বৈদেশিক বিনিয়োগের কারণে। ২০২০ সালে মালয়েশিয়ার মোট রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা এবং এর প্রায় ৩৭ শতাংশ ছিল ইলেট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস দ্রব্য বিক্রয়ের মাধ্যমে। দক্ষ জনবল, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, তুলনামূলক স্বল্প মজুরি ব্যয়, উন্নত জীবনযাত্রার মান, ডিজিটাল সংযোগ ব্যবস্থা, সরকারের বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতি ইত্যাদি মালয়েশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়নে সহায়তা করেছে।

থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো যদি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তবে নিঃসন্দেহে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার আরো উন্নতি ঘটবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশের ভাবমূর্তি একটি বড় বিষয়। সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রশস্ত রাস্তা, বিদেশী নাগরিকদের সঙ্গে ব্যবহার ও আচরণ, রাজনৈতিক পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ এবং সংযোগ (কানেক্টিভিটি) ঘটানো ও রক্ষার ক্ষমতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সম্পদের প্রাচুর্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অথবা প্রশিক্ষণযোগ্য জনবল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস ইত্যাদি বৈদেশিক বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কোনো দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ইমপ্রেশন তৈরি করে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে দূষিত পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, জনগণের অসংযত আচরণ ও ব্যবহার ইত্যাদি কোনো দেশের প্রতি নেতিবাচক ইমপ্রেশন তৈরি করে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে অবকাঠামোগত সুবিধা, উন্নত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, সহায়ক শিল্পের বিকাশ, দক্ষ ও প্রশিক্ষণযোগ্য জনবল, বাজার সুবিধা ইত্যাদি বড় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা প্রয়োজন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি বাংলাদেশে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস এবং অটোমোবাইল শিল্পে বিনিয়োগ করানো যায়, তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং এর সফল বাস্তবায়ন।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবেই বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ নিম্নমুখী। ভিয়েতনামেও প্রথমবারের মতো বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে। দেশে যেহেতু এখন বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এফডিআই আসার সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। অস্থিরতা থাকলেই অবমূল্যায়নের সুযোগ বেশি। ২৫ শতাংশের মতো স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, সেখানেই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে রক্ষণশীল হচ্ছেন। কারণ আজকে যে ডলারটা পাঠাবে, অবমূল্যায়নের কারণে সেই ডলার কালকে কমে যাচ্ছে। সরকার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে সরকার, সহজ করা হয়েছে বিনিয়োগ শর্ত। ওয়ান স্টপ সেবা চালু করার পরও আশানুরূপভাবে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন দেশে রোড শো করা হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ সুফল মেলেনি। বিদেশী বিনিয়োগ আসার বদলে প্রত্যাহারের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে নীতি ও পরিকল্পনাগত কোনো দুর্বলতা থাকলে দ্রুতই তা নিরসন করা প্রয়োজন। 

আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান ১ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এফডিআই যদি ৫-৬ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। সুযোগও রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য বিরোধ এবং হংকংয়ের ওপর চীনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হংকং থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অনেক বৈশ্বিক কোম্পানি তাদের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। তাই সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে। দফায় দফায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ আগ্রহের কথাও জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সিঙ্গাপুর বিজনেস ফেডারেশন (এসবিএফ) সম্প্রতি বাংলাদেশে পোশাক ও ওষুধ খাতে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিডার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত চার বছরে বাংলাদেশে সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। চীন ও জাপানের বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ দেখিয়েছে। ইউরোপ থেকেও অনেকে আসতে চাইছেন। পাশাপাশি এটিও সত্যি, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু শঙ্কাও কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। পাশাপাশি ট্যাক্স, শুল্ক ছাড় এবং মুনাফার প্রত্যাবাসন অন্যতম। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব সামান্যই। এছাড়া দক্ষ জনশক্তির অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জমির দুষ্প্রাপ্যতাকেও প্রতিবন্ধকতা মনে করা হয়। এদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন