আদানির চেয়ে ভারতের সরকারি বিদ্যুৎই বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী

আবু তাহের

দেশে উৎপাদনের পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে, তাতে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়েছে টাকা ১১ পয়সা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎই এখন তুলনামূলক সাশ্রয়ী। তবে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে কেন্দ্রটি থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম গড় আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গড্ডায় হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে আদানি গ্রুপ। বিশ্ববাজারে জ্বালানির বাজার বিবেচনায় বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যুক্ত হলে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হবে ১২ থেকে ১৬ টাকার মতো। যদিও উৎপাদন শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করা কঠিন বলে জানান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

গত অর্থবছরে ভারত থেকে মোট ৭৬৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বিপিডিবি। যার প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের গড় দাম পড়েছে টাকা ১১ পয়সা, যা স্থানীয় বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে ইউনিটপ্রতি খরচের অর্ধেক।

দেশে বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে এক হাজার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা দিয়ে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে।

ভারত থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় নিয়ে গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গড্ডায় আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টা খরচ হবে ১৫০ ডলার। সংস্থাটির দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আদানির প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম পড়ে প্রায় ১১ সেন্ট। আন্তঃব্যাংক ডলারের বিনিময় হার ১০৭ টাকা (২৫ জানুয়ারি) হিসাব করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ১৬ টাকা পয়সা।

আইইইএফএর ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভারতের কয়লা খনি রাজ্য হিসেবে ঝাড়খণ্ড সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সত্ত্বেও আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানি অস্ট্রেলিয়ায় তাদের নিজস্ব কয়লা খনি থেকে আমদানির পরিকল্পনা করছে। কয়লা পরিবহনে বন্দর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত ৭০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে রেললাইনের নির্মাণ ব্যয়ও বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার করা না হলেও প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয়েও তার প্রতিফলন দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরে বিপিডিবির ইউনিটপ্রতি গড় উৎপাদন ব্যয় হয়েছে টাকা ৮৪ পয়সা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল টাকা ৬১ পয়সা। গত অর্থবছরে বিপিডিবির গড়ে দশমিক ৭৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বিক্রিতে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় গত অর্থবছরে আয়-ব্যয়ের হিসাবে সংস্থাটির কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে হাজার ২৩৩ কোটি টাকা।

বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির ইউনিটপ্রতি খরচ হয়েছে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা, আর ভাড়ায়চালিত কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হয়েছে টাকা ৮০ পয়সা। জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে কেনা বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি গড় দাম পড়েছে টাকা ১১ পয়সা। অন্যদিকে, স্থানীয় গ্যাস ব্যবহার করে বিপিডিবি সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি খরচ হয়েছে যথাক্রমে টাকা পয়সা টাকা ৭৫ পয়সা।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়, বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা, উন্নয়ন তহবিলের সঞ্চিতি এবং বাজেট সহায়তার সুদ মিলিয়ে মোট ব্যয় হয়েছে ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুু আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ছিল ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে আইপিপি থেকে ৭৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ ক্রয় ব্যয় বেড়েছে। সংস্থাটি বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ আয় করেছে ৪২ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়, সঞ্চিতি এবং বাজেট সহায়তার সুদ বাবদ ঘাটতি হয় ৩১ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বিপিডিবি গত অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পেয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।

এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ইউনিটপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ৪৩ দশমিক শতাংশ। বিপরীতে গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি হ্রাস পেয়েছে দশমিক ৭৭ শতাংশ।

জ্বালানিসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছুটা সুবিধা পেয়েছে বিপিডিবি। তবে সুবিধার উল্টো দিকও রয়েছে। ভারত থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে, সেই সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশে বসিয়ে রাখতে হয়। তাতে সক্ষমতা বাবদ ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় বিপিডিবিকে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ আমদানিতে সবসময় সুবিধা পাওয়া যাবে এমনটা নয়। প্রেক্ষাপটে হয়তো আমরা সুবিধা পেয়েছি। তবে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কৌশলী হলে ধরনের সংকটে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সুবিধা পেতে পারে। আমাদের এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। নিজেদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎ খাত সাশ্রয় করা যায়, সেই পরিকল্পনা নেয়া উচিত।

গত বছরের মার্চে বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হিমশিম খেতে হয় বিপিডিবিকে। রেশনিং করেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ কমাতে পারেনি সংস্থাটি। এর ওপর ভারতের বেসরকারি সংস্থাটির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আমদানি করা হলে তাতে বিপিডিবির খরচ আরো বেড়ে যাবে।

বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, চলতি বছরের মার্চে আদানির বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রীষ্ম সেচ মৌসুম পুরোদমে চালু হলে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আনা হতে পারে। আদানি থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ আনা হবে এরই মধ্যে বিপিডিবির একটি প্রাক্কলনও পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রটি থেকে প্রায় ৩০০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানি করা হতে পারে। এর জন্য সংস্থাটিতে হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ দিতে হবে।

এদিকে বিদ্যুতের জ্বালানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করছে বিপিডিবি। সম্প্রতি এক গণশুনানিতে বিপিডিবি জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে তাদের রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। বিপিডিবির এমন আশঙ্কার মধ্যে পাইকারি খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং খুচরা বিদ্যুতের দাম শতাংশের মতো বাড়ানো হয়। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করায় পুনরায় আরো একদফা বিদ্যুতের দাম বাড়ার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।

বিদ্যুতের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, তাতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বাকি ৩০ শতাংশ তেল, জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে। এছাড়া দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশের বেশি আমদানির পরিকল্পনা নেই সরকারের বলে জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ।

দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুতের গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বেশি করা থাকলে সেটি আমাদের জন্য কখনই সুবিধার হবে না। কারণ ধরনের চুক্তি থাকলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ আমাদের কিনতেই হবে। সেক্ষেত্রে জ্বালানির দাম কমে গেলে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি বাড়ার ঝুঁকি থাকবে। কারণ বিদ্যুৎ না কিনলেও আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহারের পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি করা বিদ্যুৎ কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন