গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১৭-তে র‍্যাম্বলের সুপারিশ

বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি না করে গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ উত্তম

আবু তাহের

দেশের গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করানো হয়েছিল ডেনমার্কের প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র‍্যাম্বলকে দিয়ে। সে সময় বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা সরবরাহের ওপর মধ্যম মেয়াদি এক প্রক্ষেপণে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ব্যয় করতে হবে বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বিষয়ে র‍্যাম্বলের সুপারিশ ছিল, আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানির বিনিয়োগের অপেক্ষায় না থেকে অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হলে এখান থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল পাওয়া যাবে।

গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে র‍্যাম্বলের করা ওই সুপারিশ গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে মনে করেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। বরং স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ সংকটে আমদানির যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, সেটিকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। যদিও মূল্যের অস্থিতিশীলতা ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার থেকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় গ্যাস আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ।

গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনায় র‍্যাম্বলের দেয়া সুপারিশের সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং আমদানিনির্ভরতার সহজ সমাধান আনতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে জ্বালানি বিভাগকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্যাস খাত নিয়ে র‍্যাম্বলের সুপারিশ কাজে লাগানো গেলে এখনকার সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ . বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, র‍্যাম্বল সেই সময় বাংলাদেশের দুটি বিষয়ের ওপর সুপারিশ দিয়েছিল। প্রথমত, দেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। দ্বিতীয়ত, সেই সময় গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম ছিল যৎসামান্য। কিন্তু এরপর পাঁচ বছর কেটে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে সামান্য। কিন্তু দৃশ্যমান বা বৃহৎ আকারে কিছু হয়নি। বিশেষ করে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান তত্পরতা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে অবহেলা করা হয়েছে। সময় অপচয় করা হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান হারে দেশে গ্যাসের মজুদ কমায় চাহিদা সরবরাহে বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, সেখানে প্রায় ১৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ সংকট রয়েছে। সংকটের কারণে পেট্রোবাংলাকে রেশনিং করতে হচ্ছে। স্থানীয় শিল্প খাতের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র, আবাসিকসহ প্রতিটি খাতেই সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

মোটা দাগে চলমান গ্যাস সংকটের পেছনে বিশ্ববাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতার চেয়ে বরং স্থানীয় পর্যায়ের উত্তোলন-অনুসন্ধান নিয়ে দীর্ঘদিনের অবহেলাকে বেশি দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিনিয়োগ না পাওয়ার কারণেই খাতটি নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে।

পেট্রোবাংলার গত চার অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাপেক্সের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সময়ে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে কোম্পানিটির বিনিয়োগ হয়েছে হাজার কোটি টাকার মতো। এছাড়া বাবদ অন্যান্য সরকারি কোম্পানির বিনিয়োগও ৫০০ কোটি টাকার বেশি নয়।

গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনায় চাহিদা সরবরাহের মধ্যম মেয়াদি প্রক্ষেপণে র‍্যাম্বল প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের মূল্য হিসাব করেছিল ১০ ডলার ধরে। একই সঙ্গে ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে দৈনিক এলএনজি সরবরাহের গড় প্রাক্কলন করা ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)

কিন্তু বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতায় এখন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আনা এলএনজির দাম পড়ছে প্রতি এমএমবিটিইউ প্রায় ১৫ ডলার। আর স্পট মার্কেটে এলএনজির মূল্য এখন প্রতি এমএমবিটিইউ ২৬ ডলার ৭৬ সেন্ট (১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী) ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরে একদিকে যেমন দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির নতুন কোনো উৎস খুঁজে পাচ্ছে না, তেমনি স্পট মার্কেট থেকে গত জুলাই থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করেছে জ্বালানি বিভাগ। জাতীয় গ্রিডেও এলএনজি সরবরাহ নেমে এসেছে ৪২০ এমএমসিএফডিতে। বরং ঊর্ধ্বমুখী জ্বালানি পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ২২ শতাংশ এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫২ শতাংশ।

র‍্যাম্বলের মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনাসংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছিল, গ্যাস আমদানিতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে, তা কাজে লাগিয়ে গ্যাসসংশ্লিষ্ট কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে রাখতে পারে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল গ্যাসের দাম বাড়লে, সেখান থেকে আহরিত সম্পদ গ্যাস খাতে কাজে লাগানো যাবে। একই সঙ্গে তা হয়ে উঠবে খাতে বাংলাদেশের সাশ্রয়ী বিনিয়োগ।

কিন্তু জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গ্যাস খাতের সরবরাহ বাড়াতে গত পাঁচ বছরে এক হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি সরবরাহ সক্ষমতার দুটি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল ছাড়া আর কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে তিতাসের গ্যাসফিল্ডে কম্প্রেসার প্রতিস্থাপনের কাজও হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। একই সঙ্গে নতুন করে গ্যাসকূপ অনুসন্ধান-উত্তোলন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও বাপেক্সকে সেভাবে কাজে লাগানো যায়নি। যদিও এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখতে গিয়ে পেট্রোবাংলাকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল অর্থ বিভাগের কাছে সহায়তা চাইতে হয়েছে।

জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববাজারে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদি কোনো উৎস না পেয়ে জ্বালানি বিভাগ এখন স্থানীয় অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে। তত্পরতায় গত এক বছরে ভালো ফলাফলও পাওয়া গেছে।

২০২২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান তত্পরতা চালানোর পর অভাবনীয় সফলতাও  মিলেছে। সংস্থাটির ৮১২ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে ৭২৪ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা এলএনজির মূল্য প্রতি এমএমবিটিইউ ১৪ ডলার হিসাব করলে বলা যায়, ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রায় লাখ কোটি টাকার গ্যাসের আমদানি ব্যয় সাশ্রয় করেছে বাপেক্স।

জ্বালানি বিভাগ আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস স্থানীয় উৎস থেকে যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করেছে বাপেক্স। গত বছরে সংস্থাটির গ্যাস অনুসন্ধানে তত্পরতাও ছিল বেশি।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি বিভাগ আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাপেক্স সেই পরিকল্পনায় সর্বাত্মক কাজ করে যাবে। স্থলভাগে, পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছি আমরা। সে অনুযায়ী কখন, কোথায় কোন প্রকল্পে কাজ হবে সেটিও সাজানো হয়েছে।

দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের সব কাজ বাপেক্স করবে এমন পরিকল্পনা জ্বালানি বিভাগের। সমুদ্রভাগে বিডিংয়ের জন্য প্রস্তুতির জোর তত্পরতা শুরু করেছে। যদিও ঠিক কবে নাগাদ এই বিডিং শুরু হবে সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জ্বালানি বিভাগে সদ্য যোগদান করা সচিব . মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন