সিলেটে কোনোভাবেই থামছে না টিলা কাটা, বাড়ছে দুর্যোগঝুঁকি

নূর আহমদ, সিলেট

সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকায় অবাধে কাটা হচ্ছে টিলা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এক সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল পাহাড় টিলা। অনেক জায়গায়ই পাহাড় টিলার সেই দৃশ্য এখন আর নেই। নির্বিচারে টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলছে প্রভাবশালীরা। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও কার্যত টিলা কাটা থামছে না।

বিশিষ্টজনের দাবি, সিলেট নগরীর পরিধি বাড়ায় টিলা কাটায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। শীত, বর্ষা সব মৌসুমেই চলছে টিলা কাটা। দেখা গিয়েছে মাটি কাটার পর টিলা যখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়, তখন অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর। অন্যদিকে পরিবেশবাদীরা বলছেন, দিন দিন মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। গত বর্ষা মৌসুমে ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে সিলেটবাসীকে। যেখানে এক মাসে পৃথক টিলা ধসে পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটেছিল। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৬ সালের ভূমি জরিপের আলোকে প্রস্তুত করা তথ্যানুযায়ী, সিলেট জেলায় হাজার ২৫টি টিলা ছিল, যার মধ্যে ১৯৯টি টিলা সিলেট নগরী এর আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। তবে এসব টিলার মধ্যে অর্ধেকই এরই মধ্যে কাটা হয়ে গিয়েছে। অবশিষ্ট টিলাও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কতগুলো টিলা অবশিষ্ট আছে, তার তথ্য কোনো সরকারি কার্যালয়ে নেই।

অন্যদিকে সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশনের সীমানা ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে পাশের সিলেট সদর দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বেশকিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে ৫৮ বর্গকিলোমিটার করা হয়েছে। এতে দ্রুত পরিবর্তন আসছে এলাকাগুলোয়। একের পর গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। একই সঙ্গে চলছে টিলাকাটারও হিড়িক।

বেলা সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো প্রয়োজনেই কোনো ধরনের পাহাড়-টিলা কাটা যাবে না। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে টিলা কাটা যেতে পারে। আইনের পরিপ্রেক্ষিতেও সিলেটে টিলা কাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১১ সালের নভেম্বরে উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করে বেলা। ২০১২ সালে সেই রিটের রায়ে সিলেটে সব ধরনের টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ রয়েছে। তবে বন্ধ হয়নি টিলা কাটা, কেউ কারো কথা যেন শুনছে না।

সরেজমিনে দেখা গিয়েছে, নগরীর বালুচর, মলাইটিলা, ব্রাহ্মণশাসন, হাওলদারপাড়া, খাদিমপাড়া, মেজরটিলা, দুসকি, টিলারগাঁও, খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, গুয়াবাড়ী, জাহাঙ্গীরনগর, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলা, নালিয়া, সাহেববাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপনে পাহাড় টিলা কাটা চলছে। কোথাও প্রকাশ্যে আবার কোথাও রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে এসব টিলা।

পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হ্যারিটেজ অব এনভায়রমেন্টের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী জানান, এরই মধ্যে অর্ধেক পাহাড় টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। যেগুলো এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে ফেলেছে সিলেটকে। টিলা কেটে সাবাড় করে আমরা নিজেদের বিপদ ডেকে নিয়ে আসছি। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে টিলা কাটার ফলে অনেক টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছে। মাত্র এক মাসে জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় টিলা ধসের ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটেছে।

তিনি আরো জানান, সম্প্রতি নগরীর পরিধি বেড়েছে। এতে বাসযোগ্য জায়গার দাম চাহিদা বেড়েছে। ফলে সেসব এলাকায় ব্যাপক টিলা কাটা হচ্ছে। ব্যাপারে প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। না হয় সামনের বর্ষায় আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে পাহাড় টিলা। ধস ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমি সন্তানের সংগঠক শুয়াইব হাসান বলেন, টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্পরতা চোখে পড়ে না। টিলা কাটা সম্পন্ন হলেই অভিযান চালাতে দেখা যায়। দু-একজন শ্রমিককে কয়েক দিনের সাজা দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে মালিকরা পার পেয়ে যান। শুয়াইব মনে করেন, আইনের প্রয়োগ আরো বাড়ানো প্রয়োজন, না হয় আমাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, টিলা কাটা পুরোপুরি বন্ধে সরকারের সব দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সীমিত লোকবল নিয়ে এত বিস্তীর্ণ এলাকা চলতে থাকা টিলা কাটা বন্ধ করা কঠিন। তবু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনাও করছি। গত সপ্তাহে নগরীর আখালিয়া এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে টিলাকাটার দায়ে একজনকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অন্য অভিযানে হাওলদারপাড়ায় আরো পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। সবাই সচেতন না হলে শুধু অভিযান করে টিলা কাটা রোধ সম্ভব নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন