শিক্ষিত তরুণরা বঙ্গদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

মোল্লা জহিরুদ্দিন

মোল্লা জহিরুদ্দিন

শেষ থেকে শুরু করা যাক। সম্প্রতি বঙ্গদেশে ফরেক্স রিজার্ভ ঘাটতি নিয়ে কথা উঠেছে। এ প্রসঙ্গে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটি গল্প মনে পড়ে গেল। একবার মোল্লা সাহেব বাজার থেকে এক কেজি মাংস কিনে আনলেন। হয়তো তখনকার তুরস্কেও বর্তমান বঙ্গদেশের মতো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল, তা না হলে এক কেজি কেন কিনবেন? যা হোক, সেই এক কেজি মাংস মোল্লা সাহেবের গিন্নি এত সুন্দর করে রান্না করলেন যে নিজে লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি নিজেই পুরোটা খেয়ে ফেললেন। মোল্লা সাহেব খেতে চাইলে তার গিন্নি বললেন, ওগো, বদমাস বিড়ালটা সব মাংস খেয়ে ফেলেছে! মোল্লা নাসিরুদ্দিন বিড়ালের ওজন মাপলেন। দেখা গেল বিড়ালের ওজন এক কেজি! মোল্লা সাহেব বললেন, এটা যদি বিড়াল হয়, মাংস কই? আর এটা যদি মাংস হয়, বিড়াল কই? বঙ্গদেশের রিজার্ভের অবস্থা কিছুটা এ রকম বৈকি! রিজার্ভের ঘাটতি কমানোর জন্য বঙ্গদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধিক সংখ্যায় দক্ষ জনশক্তি রফতানির কথা বলছেন। যেহেতু অদক্ষ শ্রমিক রেমিট্যান্স হিসেবে কম ডলার পাঠান, সেহেতু বঙ্গদেশকে বেশি বেশি দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে। খুব দ্রুত দক্ষ শ্রমিক কীভাবে তৈরি করা যায়? কোনো মেশিন আছে?

আমরা সবাই শ্রমিক। শ্রমই মানুষকে মহান করেছে। আবার একই সঙ্গে আমরা ঘোড়ার মতো কেবল পেশিশক্তিনির্ভর নই। এমনকি হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাবের আগে হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিসও যন্ত্র বানিয়েছে। সেসব তারা জীবন-জীবিকায় ব্যবহার করেছে। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। তার মগজ নিয়ান্ডারথালের চেয়েও সুবিকশিত। বুদ্ধির বিকাশ হয় শিক্ষায় এবং গবেষণায়। বর্তমানে বঙ্গদেশে মাত্র পাঁচ বছর পড়লেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ১২ বছর পাঠদানকে প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে পর্যন্ত শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা। এ পর্যন্ত সবাই প্রায় একই বিষয়ে পড়বে। তারপর বিশেষায়িত শিক্ষার দিকে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেউ প্রকৌশলবিদ্যায়, কেউ চিকিত্সাবিদ্যায়, কেউ আইনে, কেউ অর্থনীতিতে, কেউ নীতিবিদ্যায়, কেউ কুরআন-হাদিসে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করবেন।

প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় যথেষ্ট বিনিয়োগ না করায় বঙ্গদেশ অধিকতর দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন করতে পারছে না। গত শতকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে হাই স্কুল আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের দাবি ছিল, সরকারি উদ্যোগে অধিকসংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠা, যাতে করে শিশু-কিশোররা আরো দক্ষ হয়ে ওঠে এবং বিকাশমান পুঁজিবাদের জন্য দক্ষ কর্মীবাহিনীর জোগান দিতে পারে। পাশাপাশি জেমস জে হেকম্যানের কথাও মনে রাখতে হবে। ২০০৮ সালে লেখা এক প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, মানব সম্পদে (Human Capital) বিনিয়োগে লাভের হার সবচেয়ে বেশি শিশুদের প্রথম বছরগুলোয় এবং প্রাক-প্রাথমিক কার্যক্রমে। অথচ ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি মনোযোগ ওপরের দিকে, নিচের দিকে কম। এ পরিস্থিতির বদল না ঘটলে মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একই সঙ্গে এ অধিকার বাস্তবায়নে অর্থের জোগান এবং এ অধিকার বাস্তবায়নের ফলে যে শিক্ষিত লোকবল তৈরি হবে তা ব্যবহারের মতো শিল্পোদ্যোগ থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা যদি না থাকে, তাহলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বঙ্গদেশের যুবক করবেটা কী? যে দেশে এ শিল্প আছে সেখানে যাবে! একেই বলে ব্রেইন ড্রেইন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলেন, তারা দক্ষ-যোগ্য লোকবল পান না। কোনটি সত্য? দুটিই। ইউরোপ-আমেরিকায় বিজ্ঞানের প্রায়োগিক বিষয়ে শিক্ষিত জনবলের চাহিদা অনেক বেশি। তাই যারা সুযোগ পাচ্ছেন তারা চলে যাচ্ছেন। তারা রেমিট্যান্সও পাঠাচ্ছেন। এখন তাই হঠাত্ করে রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং ফলে ডলার সংকট কাটানোর জন্য কোনো আলাউদ্দিনের চেরাগ নেই।

এও মনে রাখা উচিত, শুধু রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাকশিল্প দিয়ে আমরা উন্নত অর্থনীতির দেশ হতে পারব না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশ রেমিট্যান্সের মধ্য দিয়ে আসেনি, বরং এসেছে নিজেদের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। আমাদের অধিক জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে এবং দক্ষ জনবল বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠালে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। তবে এটাই একমাত্র দাওয়াই নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত, এখন অনেকে বলছেন বঙ্গদেশের শিল্পের বিচিত্রকরণ (ডাইভার্সিফিকেশন) করা দরকার। পাশাপাশি পণ্যের বাজারও বিস্তৃত করা দরকার। এর অন্যতম কারণ, বঙ্গদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় হওয়ায় বঙ্গদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে। তাছাড়া একটি পণ্য এবং একটি বিশেষ অঞ্চলের বাজার কোনোভাবেই বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের প্রমাণ হতে পারে না। আরো গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে, কেবল রফতানিনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিনা। নিজেদের পণ্য নিজেদের বাজারে বিক্রির মতো অবস্থা তৈরি করতে হবে। সেজন্য শিক্ষিত ও উত্পাদনশীল জনবল লাগবে, যারা উচ্চবেতনে কাজ করবে এবং দেশের ভেতর প্রচুর খরচও করবে বলে আশা করা যায়। চা শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধিও দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদেরও মজুরি বাড়ানো দরকার। তারা অধিক আয় করলে একই সঙ্গে তাদের ব্যয় ও সঞ্চয় বাড়বে, যা অর্থনীতিতে উত্পাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

ইদানীং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কথাটি খুব চাউর হয়েছে। ২০১৫ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব এ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন। পরের বছর একই নামে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, বঙ্গদেশে কী প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটেছে?

একসময় গাড়িয়াল ভাইয়েরা ভাওয়াইয়া গান গাইতে গাইতে গরুর গাড়ি চালিয়েছেন। যানবাহন হিসেবে পশুর ব্যবহার অনেক পুরনো। উন্নত বিশ্বে এখন আর পশুরও ব্যবহার হয় না। সব যন্ত্রচালিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বঙ্গদেশে এখনো মানুষ পশুর মতো রিকশা টানে। অথচ এটাকেই কিনা তারা ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সেই বঙ্গদেশের সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলে তখন তা বেশ হাস্যকর লাগে। অনেকটা যানজটে আটকে থেকে উড়ন্ত গাড়ির স্বপ্নময় রূপকথার মতো!

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের অর্জন ছিল বিদ্যুত্, অভ্যন্তরীণ কম্বাসশন ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন এবং টেলিযোগাযোগ। বঙ্গদেশের বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুতে উত্পাদন বৃদ্ধি পেলেও স্বল্পখরচে বিদ্যুত্ উত্পাদনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় বর্তমানে বিদ্যুত্ বিভ্রাটে পড়তে হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ইস্যু। এটি নিয়ে তারা কতটা ভাবছেন? জ্বালানি ছাড়া আমরা এক পাও এগুতে পারব না। আবার আমাদের পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে।

বঙ্গদেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ফসল নিউক্লিয়ার জ্বালানি ব্যবহার করতে চায়। তারা কি প্রযুক্তিগত দক্ষতা আয়ত্ত করে নিচ্ছে? নাকি বিদেশী প্রকৌশলীদের দিয়ে কেবল বড় বড় প্রকল্প করেই খালাস? এদিক থেকে কিছু কিছু উন্নতি তাদের হচ্ছে। আরো বিপুল উদ্যোগে প্রাযুক্তিক জ্ঞান আহরণ করতে হবে। সম্প্রতি ভ্লাদিমির পুতিন তার ভালদাই বক্তৃতায় রাশিয়ার প্রাযুক্তিক জ্ঞান হস্তান্তরের কথা তুলে ধরেছেন। বঙ্গদেশকেও এ ব্যাপারে তাদের তুলনায় উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে জ্ঞানগত সাহায্য নিতে হবে। নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এর বিকল্প নেই।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনেক প্রতিশ্রুতি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু এ পর্বের বিপ্লব কি জীবাশ্ম জ্বালানি ও বিপজ্জনক জ্বালানির সংকট থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে পারবে? পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে বঙ্গদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তাকে এ সংকট মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিতে হবে। এজন্য শিক্ষা ও গবেষণায় মনোযোগ বাড়াতে হবে। আজকের তরুণ-তরুণীরা তাদের ভবিষ্যত্ পৃথিবী নিয়ে ভাবছে। তাদের সে ভাবনায় ও গবেষণায় সাহায্য করাটা বঙ্গদেশের সরকারের দায়িত্ব।

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পেছনে ভূমিকা রেখেছে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন, নবজাগরণ এবং উপনিবেশ স্থাপন। এ শেষেরটির ক্ষতিকর দিকের শিকার হয়েছে বঙ্গদেশ। কার্ল মার্ক্স লিখেছেন, কী নির্মমভাবে ঢাকার বস্ত্রশিল্পকে ব্রিটিশ রাজত্ব ধ্বংস করেছে। অবশ্য মার্ক্স মনে করতেন, ব্রিটিশরা বঙ্গদেশে বিপ্লব ঘটাবে। সেটা হয়নি। হওয়ার কথাও না। ব্রিটিশ আমলের বঙ্গদেশ ছিল কাঁচামাল সরবরাহ ও ব্রিটিশদের কারখানায় তৈরি পণ্যের বাজার। সে কারণে ব্রিটিশ আমলে বঙ্গদেশে শিল্প বিপ্লব হওয়া সম্ভব ছিল না, বরং স্বাধীন নবাবী আমলে যে দেশী ব্যবসায়ী শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছিল তা সমূলে উত্পাটিত হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ নীতির ফলে এদেশের মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে। তাদের জ্ঞানচর্চার ধারা নষ্ট হয়েছে।

লেনিন তার বিখ্যাত পুস্তক Development of Capitalism in Russia শুরু করেছেন এডাম স্মিথ প্রদত্ত শ্রম বিভাজন নীতি নিয়ে আলাপের মাধ্যমে। শুরুতে তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের কথাও উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ইমান্যুয়েল ওয়ালারস্টাইন ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থিওরি দিয়েছেন। তিনিও আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ বিশ্ব ব্যবস্থায় ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকবে। এ কেন্দ্রের বাইরে পরিধিতে বা প্রায়-পরিধিতে থাকা রাষ্ট্রগুলো স্বল্প মজুরিতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্পে নিয়োজিত থাকবে। বঙ্গদেশকে এ বিশ্ব ব্যবস্থা ভাঙায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

শেষ করা যাক। যাকে দিয়ে শুরু করেছিলাম তাকে দিয়েই শেষ করি। একবার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের চাবি হারিয়েছেন। তো, তিনি তার বাগানে চাবি খুঁজছেন। তার এক পড়শি এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খুঁজছেন মোল্লা সাহেব? মোল্লা নাসিরুদ্দিন জবাবে বললেন, চাবি খুঁজছি। পড়শি এসে চাবি খোঁজায় হাত লাগালেন। একটু পর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা মোল্লা সাহেব, ঠিক কোথায় চাবিটি হারিয়েছেন? মোল্লা সাহেব জবাব দিলেন, আমার ঘরে। পড়শি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাহলে এখানে খুঁজছেন কেন? মোল্লা সাহেবের জবাব, যেখানে খোঁজার সুবিধা সেখানেই তো খুঁজব! বঙ্গদেশের অর্থনৈতিক সংকটের সমাধানের চাবি ঠিক জায়গায় খুঁজতে হবে।

মোল্লা জহিরুদ্দিন : শিক্ষানবিস আইনজীবী, গবেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড এডুকেশন এর প্রতিষ্ঠাতা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন