নয়াপল্টনে পুলিশ বিএনপি সংঘর্ষ

যুবক নিহত, আহত অনেক, রিজভী-আমানসহ শতাধিক আটক

নিজস্ব প্রতিবেদক

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মির্জা ফখরুলের অবস্থান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বিভাগীয় সমাবেশ সামনে রেখে রাজধানীর নয়াপল্টনে জড়ো হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে একজন নিহত আহত হয়েছে অনেকেই। গতকাল বিকাল ৪টায় শুরু হয় উত্তেজনা। মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ কাঁদানে গ্যাসের শেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দলটির শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ।

রাজধানীতে ১০ ডিসেম্বর ডাকা বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে কয়েকদিন ধরেই উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিলেও দলটির দাবি নয়াপল্টন। এর মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীরা গতকাল সকাল থেকে নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন। পুলিশও সতর্ক অবস্থান নেয়। বেলা ৩টার কিছু পরে নেতাকর্মীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে গেলে শুরু হয় সংঘর্ষ। একের পর এক ককটেল ফোটানো হয়। পুলিশ ছোড়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল গুলি। একসময় সেখান থেকে আহতাবস্থায় আটজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে মকবুল হোসেন নামে এক যুবককে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নয়াপল্টন থেকে আনা হয়েছিল মকবুল হোসেনকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মকবুল হোসেনের শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় আরো সাতজন আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে।

এদিকে সংঘর্ষের মধ্যেই বিকাল ৪টার দিকে বিএনপি কার্যালয় ঘিরে ফেলে পুলিশ। পরে কার্যালয়ের ভেতরে অভিযান চালিয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় শহীদ উদ্দীন চৌধুরী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সমাবেশের স্থান নিয়ে আলাপ করার কথা জানিয়ে হায়াতুল ইসলাম ফোন করে আমাকে ডেকেছিলেন। নিচে আসার পর দেখি গোয়েন্দা পুলিশ। তারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমি জানি না। নয়াপল্টনে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ হবে, নিয়ে বিতর্ক নিরসনে সমঝোতার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে হায়াতুল ইসলাম খান বিএনপির পক্ষ থেকে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

পুলিশি অভিযানের মধ্যেই নয়াপল্টনে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে পুলিশের বাধায় তিনি সময় ভেতরে ঢুকতে পারেননি। মির্জা ফখরুল তখন বলেন, আমার দলের কার্যালয়ে কেন আমি ঢুকতে পারব না? সবার দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। পুলিশের এক সদস্যকে সময় বলতে শোনা যায়, আপনাকে আমরা ঢুকতে দিতে পারি না। কারণ ভেতরে বিস্ফোরক আছে। আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই সেখানে ঢুকতে দিতে পারি না। এর প্রায় ২০ মিনিট পর মির্জা ফখরুলকে কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। তবে না ঢুকে কার্যালয়ের সামনেই বসে পড়েন তিনি। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন বিএনপি মহাসচিব।

সংঘর্ষের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটা ভয়াবহ, ভীতিকর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তারা। আমাকে আমার কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেয়া হচ্ছে। অথচ পুলিশ, বোম ডিসপোজাল ইউনিটের লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমরা সন্দেহ করছি, তারা ভেতরে বোমা-জাতীয় কিছু রেখে এর দায় আমাদের ওপর চাপাবে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা সমাবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করছে। অবিলম্বে নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয় থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি জানান মির্জা ফখরুল।

এদিকে বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চলার মধ্যেই মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। সংঘর্ষে হতাহতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তখন একটা মিটিংয়ে ছিলাম। আমরা ব্যাপারটা দেখছি। কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে শুনেছি। রাজনৈতিক সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে বিশেষায়িত অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াতকে নামানোর কারণ জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সেখানে অনেকগুলো ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। আমরা শুনেছি সেখানে চাল, ডাল, লাকড়ি জড়ো করা হয়েছে। তাই নগরবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ সেখানে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে।

রাজধানীর শৃঙ্খলা রক্ষায় রাস্তায় কোনো অবস্থায়ই বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমাদের কথা সুস্পষ্ট, তারা রাস্তায় সমাবেশ করতে পারবে না। খোলা মাঠে তাদের সমাবেশ করতে হবে। আর তা না হলে আইনানুগভাবে যতখানি কঠোর হওয়া যায় ততখানি হবে পুলিশ।

গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আমরা গোয়েন্দা সংস্থা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ওই সমাবেশে বিএনপি ১০ লাখ লোকের সমাগম ঘটাবে। অথচ নয়াপল্টনে সর্বোচ্চ ৭০-৮০ হাজার লোক ধরবে। বাকি নয় লাখ লোক ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়লে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ তত্পর। নগরবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ এটা হতে দিতে পারে না। তাছাড়া এর আগে বিভাগীয় শহরগুলোতে তাদের যে সমাবেশ হয়েছে তার কোনোটাই রাস্তায় হয়নি, সবই হয়েছে মাঠে। টঙ্গীতে সমাবেশ করার পরামর্শ দিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিয়েছি, কিন্তু পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি যে তারা সেখানে যেতে আগ্রহী নয়। আমরা তাদের টঙ্গী ইজতেমা মাঠ, পূর্বাচলের বাণিজ্য মেলা মাঠের প্রস্তাবও দিয়েছি, যেখানে ১০ লাখ লোকের জায়গা হওয়া সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন