বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না হাই-টেক পার্ক

সহজ শর্তে অর্থায়ন ও দক্ষ জনবল তৈরির ব্যবস্থা করা হোক

২০২৫ সাল নাগাদ আইটি খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রফতানি আয় আইটি ডিভাইস উৎপাদন শিল্পে অন্তত এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১০ সাল থেকে। আজ এক যুগ পর এসে খবর মিলছে, বিনিয়োগ আকর্ষণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি কোনো লক্ষ্যই অর্জন হয়নি। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্কগুলোয় কার্যক্রম চালাচ্ছে খুবই স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও কমে এসেছে। জমি ফ্লোর স্পেস বরাদ্দ নেয়ার পর উৎপাদন শুরুই করেনি অনেকে। ফলে বিপুল পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ হলেও তা অব্যবহূতই পড়ে থাকছে। সীমিত সম্পদ বিপুল শিক্ষিত বেকারের দেশের জন্য এমন খবর উদ্বেগজনক। এতে করে যেসব লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে সরকার হাই-টেক পার্ক বাস্তবায়ন করেছিল, তা ঝুঁকিতে পড়বে।

ডিজিটাইজেশনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।ডিজিটাল বাংলাদেশবাস্তবায়নে দেশী প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেয়ার নির্দেশ রয়েছে সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চান দেশে প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনবলের বিকাশ ঘটুক। তা সত্ত্বেও আমাদের অগ্রগতি কম। দেশের সরকারি বেসরকারি খাতে কাজের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সফটওয়্যার ব্যবহার এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে এসএপি ওরাকল মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানের সলিউশনগুলো সবার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। কিন্তু ধরনের সফটওয়্যার ইমপ্লিমেন্টেশনের ক্ষেত্রে যে দক্ষ লোকবল দরকার তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই এসব সফটওয়্যার ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্য প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক বীমা, গ্রুপ অব কোম্পানিজ, ফার্মাসিউটিক্যাল, গার্মেন্টস সেক্টর, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, অটোমোবাইল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, এনার্জি সেক্টর, হাসপাতাল ইত্যাদি অটোমেশনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ইআরপি সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। যে ইআরপি সফটওয়্যারগুলো জার্মানি, আমেরিকা বা ইসরায়েলের বানানো। বাংলাদেশের দক্ষ জনবলের অভাবে সে সফটওয়্যারগুলো বাংলাদেশে ইমপ্লিমেন্টেশনও করছে ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার মতো দেশ। এসব করেই ভারত আয় করছে একটি বিশাল অংকের টাকা। বাংলাদেশের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো আশানুরূপ আয় করতে পারছে না তাদের দক্ষ জনবলের অভাবে।

আইটি খাতের এত এত সাফল্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এর সামনে রয়েছে শুরু থেকেই অনেক বড় বড় বাধাবিপত্তি। আইটি খাতে সাফল্যের জন্য সব থেকে বেশি প্রয়োজন কানেক্টিভিটি, সেই কানেক্টিভিটির পথে সমস্যা হিসেবে দেখা যায় ধীরগতিসম্পন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে, যার কারণে প্রত্যন্ত এলাকায় যথাযথ এমনকি একান্ত প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক অনুপস্থিতি আইটি খাতের প্রধান উদ্দেশ্যকে সমস্যায় ফেলছে। হিসাবমতে, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০ হাজার বিভিন্ন পর্যায়ের স্নাতক এবং প্রকৌশল আইটি খাত থেকে ১০ হাজার স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী বের হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা আইটি বিষয়ে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করার কথা তা পারে না, যার কারণে তাদের পুনরায় ট্রেনিং নিতে হচ্ছে। এসবের কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় ব্যবহারিক শিক্ষার অভাব ইন্ডাস্ট্রি একাডেমির মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি না হওয়া, তাই এসব দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যাতে খাতের প্রয়োজনের দিকে নজর রেখে কারিকুলাম তৈরি করা যায়। হাই-টেক পার্কে বরাদ্দপ্রাপ্তদের অভিযোগ, যেসব প্রতিশ্রুতি কর্তৃপক্ষ দিয়েছিল তার অধিকাংশই তারা পূরণ করেনি। তাছাড়া সহজ শর্তে অর্থায়ন দক্ষ জনবল সরবরাহের মতো বিষয়কেও বিবেচনায় রাখতে হবে।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় ১৯৯০ সালে টাটা গ্রুপের হাত ধরে এসব এন্টারপ্রাইজ সফটওয়্যার ব্যবহারের গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমানে এসব সফটওয়্যার ইমপ্লিমেন্টেশনে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের সক্ষমতার ব্যবধান অনেক। টাটা কনসালটিং লিমিটেড তাদের ব্যবসায় ধরনের সফটওয়্যার কনসালট্যান্সি এবং ইমপ্লিমেন্টেশন তাদের ব্যবসার মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তারই ফলে ভারতজুড়ে ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি দক্ষ জনবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্বব্যাপী ধরনের দক্ষতার ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভারতজুড়ে রাতারাতি অনেক কোম্পানি ধরনের দক্ষ জনবল তৈরি করে বিভিন্ন ইমপ্লিমেন্টেশন প্রজেক্টের সঙ্গে নিজেদের দেশের জনবলকে সম্পৃক্ত করে। ভারতেরইনফোসিসএমন এক প্রতিষ্ঠানের নাম, যা আইটির দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে পৃথিবীতে এক রোল মডেল।

সরকার আইটি খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এবং এর অগ্রযাত্রা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে দিতে বিভিন্ন সময়োপযোগী উদ্যোগ নিচ্ছে, যা প্রশংসনীয়। অনেক আগে থেকেই আইটি খাত নিয়ে আশার স্বপ্ন দেখছে সরকার। আইটি খাতের উন্নয়নে এরই মধ্যে সরকার ২০২৪ সাল পর্যন্ত খাতের সব ট্যাক্স মওকুফ করে দিয়েছে। যেমন কেউ সফটওয়্যার রফতানি করলে ১০ শতাংশ প্রণোদনা পাবে। দেশী সফটওয়্যার ব্যবহারে করপোরেট ট্যাক্স যাতে কমিয়ে দেয়া হয় এবং বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহারে যাতে ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া হয়, সে বিষয়ে নীতি প্রণয়নে উচ্চপর্যায়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো যে ক্রমবর্ধমান আইটি খাতকে এগিয়ে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু লক্ষ্যের সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা কাম্য নয়। এক্ষেত্রে ঠিক কী কারণে হাই-টেক পার্কগুলোয় বরাদ্দকৃত জমি ফ্লোর ফাঁকা থাকছে সেগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান জরুরি। দক্ষ জনবল বিনিয়োগ তহবিলের অভাবের কথা কিছু উদ্যোক্তা বলছেন। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী সহযোগিতা প্রদান করা যেতে পারে দ্রুতই তার একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি।

বর্তমান আধুনিক সভ্যতার উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি নির্ভর করছে তথ্য প্রযুক্তির ওপর। আজকের বিশ্বের সম্পদ হিসেবে যেহেতু তথ্যকে বিবেচনা করা হয়, সেহেতু তথ্যের আধুনিক ব্যবহারে প্রযুক্তির সংযোগ থাকবে সর্বোত্তমভাবে এবং তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি সম্পদ যথাযথভাবে কাজে দেবে। বর্তমানে আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা সম্পূর্ণভাবে আইসিটি-নির্ভর। আর এই আইসিটি গঠন হয়েছে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, নেটওয়ার্ক ইত্যাদির সমন্বয়ে। আর সবকিছুর সমন্বয় শুধু তথ্যের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। আইটি খাতকে বর্তমান যুবসমাজ খুবই আগ্রহের সঙ্গে নিচ্ছে এবং যথাযথ সাফল্যও অর্জন করতে পারছে। বাংলাদেশে আইটি সেক্টর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধে এই সেক্টরকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকার নিজেও আইটি সেক্টর নিয়ে আশাবাদী। দ্রুত সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, যা সংকটে থাকা আর্থিক খাতকে কিছুটা হলেও স্বস্তি বাড়াবে। এছাড়া বাড়বে কর্মসংস্থান।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ খাতে এনেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আমরা দেখেছি, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশনিয়ে প্রথম দিকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নানা মহলে উত্থাপিত হলেও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে তথ্যপ্রযুক্তি এখন কেবল রাজধানী কিংবা বড় শহরে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে। বিশেষত মোবাইল ফোনের গণবিস্তৃতি কাজকে সহজ করে দিয়েছে। বেসরকারি নানা গবেষণা-সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, সরকারি সেবা পাওয়া সহজ হয়েছে। সফটওয়্যার পার্ক হাই-টেক পার্ক স্থাপন এরই ধারাবাহিকতায় চৌকসতম উদ্যোগ। চাকরির জন্য অন্যের দরজায় না ঘুরে তরুণদের নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তা হিসেবে অন্যের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন, এসব পার্কের মাধ্যমে তার বহু বহুমাত্রিক দুয়ার খুলে যাবে। এক্ষেত্রে সফটওয়্যার পার্ক উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শ প্রণিধানযোগ্য যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এড়াতে হবে। বাংলাদেশের সীমিত সম্পদে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে হলে এর বিকল্প নেই। তথ্যপ্রযুক্তি খাত উন্নয়ন বিকাশের ব্যাপারে নীতিগত পর্যায়ের সদিচ্ছা যাতে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমেও যথাযথ প্রতিফলিত হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন