জ্বালানি সংকটের মধ্যেই ইস্টার্ন রিফাইনারির ২০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রথম ইউনিট ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চলমান জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষিত বিবেচনায় মুহূর্তে ধরনের প্রকল্পের উপযোগিতা রয়েছে কিনা সে বিষয় প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, প্রতিকূল মূল্য পরিস্থিতি ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনমাফিক জ্বালানি তেলের সংস্থান করা যাচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। চাপে পড়ে যাওয়ায় মুহূর্তে ইআরএলের বর্তমান সক্ষমতা পূরণের মতো জ্বালানি তেল আমদানিও কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতিতে শিগগিরই পরিবর্তন আসারও সম্ভাবনা নেই। অবস্থায় বিপুল ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও আদতে এর সুফল পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

আমদানীকৃত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে ইআরএলের ৩০ লাখ টন সক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালে। গত ১২ বছরে ১০ বার ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে প্রকল্পটির। সম্প্রতি নতুন করে প্রায় ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দিয়ে ১১তমবারের মতো সংশোধিত ডিপিপি প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশনের পর্যবেক্ষণ যাচাই-বাছাই শেষে এটি অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হবে।

বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বের কোথাও নতুন করে কোনো জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার তৈরি করা হয়নি। কারণ পরিবহন খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বাজারে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন আসছে। ধরনের পরিশোধনাগারে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগের ভাবনা থেকেও অনেক দেশ বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশে যে পরিশোধনাগারটি হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি যদি আরো পাঁচ বছর আগে নির্মাণ করা যেত, তাহলে হয়তো বৃহৎ আকারে এর সুবিধা নেয়া যেত। তবে এটি নির্মাণে যে সময়ের প্রয়োজন, নির্মাণের পর সেটি থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

২০১০ সালে প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পরে ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা সংশোধিত ব্যয় ধরে দ্বিতীয় ইউনিটের প্রকল্প পাস করা হয়। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হয়। গত বছর প্রকল্পের ডিপিপি দশমবারের মতো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সংশোধিত ওই ডিপিপিতে চূড়ান্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৮৩৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। সর্বশেষ সংশোধনীতে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

বিপুল পরিমাণ ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা ইআরএলের হোল্ডিং কোম্পানি বিপিসির জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। খোদ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরাও মনে করছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় বিপিসি আর্থিকভাবে অনেক চাপে পড়েছে। এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় নির্বাহ বিপিসির একার পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রকল্পটির পাঁচটি অংশের কাজের অগ্রগতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস (দুটি প্রতিষ্ঠান), অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্তকরণের প্রাথমিক কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির জন্য সরকারি খাসজমি, জেমকো পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে মোট ৫৯ একর জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৬২০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এছাড়া ইআরএল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমি দেয়া হচ্ছে ১২৩ দশমিক ১২৭ একর। দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প শুরু না হলেও এরই মধ্যে বাবদ প্রায় হাজার ৫৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এর মধ্যে জমি লিজ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৬২০ কোটি ৫৪ লাখ, ফিড প্রকল্পের হালনাগাদ খরচ ৩৯৬ কোটি ৭৪ লাখ পিএমসি প্রকল্পের হালনাগাদ খরচ করা হয়েছে ৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত ইউনিটটিতে ইউরো- মানের গ্যাসোলিন ডিজেল উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যমান রিফাইনারির ডিজেলকে ইউরো- মানে রূপান্তর করা হবে। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে এলপিজি, গ্যাসোলিন, জেট ফুয়েল-, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল বিটুমিন উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে নতুন দুটি পণ্য, লুব বেজ অয়েল সালফার উৎপাদন হবে। ইআরএলের প্রথম ইউনিটটি নির্মাণ হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। নির্মাণ করেছিল ফরাসি প্রতিষ্ঠান টেকনিপ। দ্বিতীয় ইউনিটটিও টেকনিপেরই নির্মাণ করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য টেকনিপের পক্ষ থেকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা চাওয়া হয়েছিল। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলে নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বান করা হবে।

বিপিসি ইআরএলের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর জ্বালানির চাহিদা রয়েছে ৫৫-৬০ লাখ টনের বেশি। ইআরএলের জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। বর্তমানে সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৯৬-৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে ইআরএলের সক্ষমতা আরো ৩০ লাখ টন বেড়ে দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টনে।

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বণিক বার্তাকে বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের প্রকল্পটির মেয়াদ ব্যয় সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় জুনে। পরে আগস্টে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় ডিপিপি নিয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ পুনর্গঠনে কাজ করা হচ্ছে। আশা করছি দ্রুতই প্রকল্পটি একনেকে পাঠানো হবে। প্রকল্পটি নিয়ে আর কোনো জটিলতা কিংবা সময়ক্ষেপণ হবে না। একনেকে পাস হওয়ামাত্রই কাজ শুরু হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন