বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য

আমদানি নিয়ন্ত্রণ হলেও কমছে না ঘাটতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানে নিয়ন্ত্রণে এসেছে আমদানির নতুন ঋণপত্র (এলসি) গত তিন মাসে ধারাবাহিকভাবে নতুন এলসি খোলা কমেছে। ২০২২ সালের মার্চে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৯৮০ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে ৫৭০ কোটি ডলারে। সে হিসাবে ছয় মাসে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ।

এলসি খোলার সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামলেও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কমছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪৫৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতির পরিমাণও দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি ডলারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিতে নতুন এলসি খোলা কমলেও পুরনো এলসি নিষ্পত্তি বাড়ছে। রেমিট্যান্সের বড় পতনের পাশাপাশি রফতানি প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে এসেছে। কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও বড় হচ্ছে। এছাড়া গত অর্থবছরের রেকর্ড আমদানির দায় পরিশোধের চাপে বৈদেশিক বাণিজ্যের রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে কমছে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে আরো অন্তত এক বছর সময় লাগবে।

অর্থনীতিবিদ . সেলিম রায়হানও মনে করছেন বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঘিরে সৃষ্ট চাপ শঙ্কা শিগগিরই কাটছে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যালান্স অব পেমেন্টে যে ঘাটতি আমরা দেখেছি, সেটি নজিরবিহীন। রেকর্ড ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্নমুখী তত্পরতার কারণে আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ঋণপত্রের নিষ্পত্তি এখনই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। গত অর্থবছরে রফতানিতে যে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, সেটি বছর থাকছে না। বিদ্যমান বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। রিজার্ভসহ ডলারের বাজারে যে সংকট অনিশ্চয়তা চলছে, সেটি শিগগিরই কমবে বলে মনে হয় না। আমদানির নতুন ঋণপত্র কমিয়ে আনতে পারা প্রাথমিক সফলতা। তবে এটি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। আরো কোন কোন পদক্ষেপ নিলে রফতানি রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাবে, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোয় হাজার ৮০৮ কোটি বা ৬৮ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ে নতুন এলসি খোলা হয়েছিল হাজার ৩০ কোটি ডলারের। ২০২২-এর প্রথম নয় মাসে নিষ্পত্তির পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে হাজার ৩৫৪ কোটি ডলারে। গত বছরের একই সময়ে হাজার ৬৯৪ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল। চলতি বছরে প্রায় বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি বেশি খোলার পাশাপাশি সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি বেশি নিষ্পত্তি হয়েছে। রেকর্ড এলসি নিষ্পত্তির চাপেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় হার উঠেছিল ১২০ টাকা পর্যন্ত। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে তা এখন কিছুটা কমে এসেছে। গতকাল ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১০৫ টাকা ২০ পয়সা।

গত অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এলসি খোলা হয়েছে অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সময়ে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। জুনের পরে বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলাসপণ্যের এলসি মার্জিনের হার শতভাগে উন্নীত করা হয়। এর বাইরেও নানা শর্ত ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ফলে জুলাই থেকে নতুন এলসি খোলার পরিমাণও ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। জুলাই আগস্ট দুই মাসের প্রতিটিতে দশমিক বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হলেও সেপ্টেম্বরে তা দশমিক বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

আমদানির ঋণপত্র খোলা কমিয়ে আনতে পারাকে সফলতা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার রফতানি রেমিট্যান্সের বড় পতনে শঙ্কাও দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি ঋণপত্রের লাগাম টেনে ধরতে পারাটি প্রাথমিক সফলতা। সেপ্টেম্বরে নতুন ঋণপত্র খোলার পরিমাণ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো রফতানি রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা এখনো আসেনি। বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ইতিহাস সৃষ্টি করা আমদানি ব্যয় দেশের অর্থনীতিতে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করে। অর্থবছর শেষে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতিও দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে বিওপি উদ্বৃত্ত ছিল দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সূচকগুলোর চাপ চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলারে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ৪২৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। একই সময়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ঠেকেছে ২৩৬ কোটি ডলারে। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে বিওপিতে ২২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

আমদানি দায় পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। এতে চাপের মুখে পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৩ শতাংশের বেশি।

বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা কমাতে গত মাসে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর থেকে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার সচল হয়। প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির চাপ কিছুটা হলেও কমে আসে। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চার মাস ধরে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার বলতে কিছুই ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দর আর বাজার পরিস্থিতি ছিল একেবারে ভিন্ন। ব্যাংকগুলোকে ১১৪ টাকারও বেশি দরে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়ার পর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে লেনদেন শুরু হয়েছে। এখন প্রয়োজন অনুযায়ী এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারছে। তবে ডলারের সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। মুহূর্তে আমদানির নতুন এলসি খোলার চাপ কমলেও নিষ্পত্তির চাপ কমছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন