অধ্যাপক ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে। বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষার গুরুত্ব এবং ক্যারিয়ারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত বিপ্লব
ভেটেরিনারি শিক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভেটেরিনারি
শিক্ষা তিনটি
কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, প্রাণী
স্বাস্থ্যের সুরক্ষা
নিয়ে ভেটেরিনারিয়ানরা
কাজ করে।
দ্বিতীয়ত প্রাণী
ও মানুষের
মধ্যে নিবিড়
সম্পর্ক রয়েছে।
এ দুইয়ের
মধ্যে পারস্পরিক
নির্ভরতা যেমন
রয়েছে তেমনি
জুনোটিক রোগ
সংক্রমণেরও একটা
শঙ্কা থাকে।
জুনোটিক রোগের
সংক্রমণ প্রতিরোধ
এবং সার্বিক
ব্যবস্থাপনায় ভেটেরিনারিয়ানরা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে।
তৃতীয়ত হচ্ছে
কনজারভেশন। অর্থাৎ
মানুষের কারণে
অনেক প্রাণী
বিলুপ্ত হচ্ছে।
ফলে প্রকৃতিতে
এক ধরনের
ভারসাম্যহীনতা তৈরি
হচ্ছে। এ
কনজারভেশনে ভেটেরিনারিয়ানদের
একটা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রয়েছে।
গবেষণায় ভেটেরিনারিয়ানদের
অবদান রাখার
সুযোগ রয়েছে।
এজন্য শিক্ষার
সম্প্রসারণ দরকার।
কারণ ভেটেরিনারি
শিক্ষার সমৃদ্ধির
সঙ্গে জাতীয়
উন্নয়নের অগ্রগতি
সম্পর্কিত। মানুষের
স্বাস্থ্য সুরক্ষা
ও খাদ্যনিরাপত্তায়
ভেটেরিনারির ভূমিকা
রয়েছে। এসব
কারণেই ভেটেরিনারি
শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
ভেটেরিনারি শিক্ষায় ক্যারিয়ার কেমন?
আগে
শুধু পারিবারিক
খামার ছিল।
মানুষ বসতবাড়িতে
ছোট পরিসরে
পশুপাখি পালন
করত। কিন্তু
এখন বাণিজ্যিক
খামারের পর্যায়ে
চলে গিয়েছে।
পোলট্রি বা
ডেইরিতে বাণিজ্যিক
খামারের একটা
নীরব বিপ্লব
হয়েছে। মানুষের
লাভ-লোকসানে
ভেটেরিনারিয়ানরা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করে। সরকারিভাবে
কাজ করার
সুযোগ রয়েছে।
পাশাপাশি বেসরকারি
খাতে এখন
মেডিসিন ও
খাবারে ভেটেরিনারিয়ানদের
একটা বড়
সুযোগ তৈরি
হয়েছে। এছাড়া
গবেষণায় একটা
বড় সুযোগ
রয়েছে। অর্থাৎ
ভেটেরিনারি শিক্ষায়
একমুখী নয়
বরং বহুমুখী
ক্যারিয়ার গড়ার
সম্ভাবনা রয়েছে।
পশুপাখির রোগবালাই প্রতিরোধে কী
কী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি?
পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশেই
পশুপাখি নানা
রোগবালাইয়ে আক্রান্ত
হয়। যেমন
লাম্পি স্কিন
আফ্রিকান রোগ।
কিন্তু বাংলাদেশেও
এখন এ
রোগে গরু
আক্রান্ত হচ্ছে।
সময়ে সময়ে
বিভিন্ন রোগের
সংক্রমণ ছড়িয়ে
পড়ে। এটা
প্রকৃতির নিয়ম।
ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার
মতো দেশেও
আফ্রিকা থেকে
সংক্রমণ ছড়িয়েছে।
আগে তুলনামূলকভাবে
রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা
কম ছিল।
কিন্তু এখন
মানুষের যোগাযোগ
ব্যবস্থা ভালো
হওয়ার কারণে
রোগে আক্রান্ত
হওয়ার সম্ভাবনা
বেড়েছে। এটা
মানুষের ক্ষেত্রেও।
রোগবালাই প্রতিরোধে
যেকোনো দেশকে
কয়েকটি পদ্ধতি
মেনে চলতে
হয়। প্রথমত,
প্রতিরোধ করতে
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
করতে হবে।
এরপর যেকোনো
রোগের প্রাদুর্ভাবের
ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতি
থাকতে হবে।
রোগের প্রাদুর্ভাব
চিহ্নিত করতে
হবে এবং
সে অনুযায়ী
সংক্রমণ যেন
না ছড়ায়
তার জন্য
দ্রুত ব্যবস্থা
নিতে হবে।
এ চার
পদ্ধতি মানুষের
ক্ষেত্রেও প্রজোয্য।
রোগবালাই প্রতিরোধে
এর কোনো
বিকল্প নেই।
যেমন লাম্পি
রোগ প্রথমে
মেহেরপুর অঞ্চলে
এসেছে। আমরা
যদি প্রথমে
সেটা চিহ্নিত
করতে পারতাম
তাহলে কিন্তু
এ রোগের
এত ব্যাপকতা
হতো না।
এর মূল
দায়িত্ব সরকারের।
কারণ একটি
রোগ ছড়িয়ে
পড়লে খামারিরা
এককভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হবেন না।
বরং পুরো
দেশের মানুষকে
ভুগতে হয়।
মানুষের প্রোটিন গ্রহণের বড়
একটি অংশ
ভেটেরিনারি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা কম।
এক্ষেত্রে করণীয়
কি?
ভেটেরিনারি
নিয়ে মানুষের
জানাশোনা কম,
এটা সত্য।
তবে ধীরে
ধীরে এ
অবস্থার উন্নতি
হচ্ছে। ৪০-৫০
বছর আগে
কেউ চিন্তা
করেনি ভেটেরিনারি
নিয়ে বিশেষায়িত
বিশ্ববিদ্যালয় হবে।
কিন্তু এখন
হয়েছে। দেশে
এখন মোট
১২টি ভেটেরিনারি
শিক্ষা সম্পর্কিত
প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এ পরিবর্তন
তিনটি বিষয়ের
সঙ্গে জড়িত।
অর্থনীতির উন্নয়ন,
খামার পরিচালনা
ও ব্যবস্থাপনার
উন্নয়ন এবং
ব্যবসায়ী দিক।
এগুলো যত
উন্নয়ন হবে
ভেটেরিনারি শিক্ষার
গুরুত্ব তত
বাড়বে। সামাজিক
গ্রহণযোগ্যতাও এখন
বাড়ছে। আগে
মানুষের মধ্যে
ভেটেরিনারি নিয়ে
এক ধরনের
অবহেলা ছিল।
কিন্তু বিষয়টি
তো একটি
আরেকটির সঙ্গে
সম্পর্কিত। মানুষের
স্বাস্থ্যেও এর
প্রভাব রয়েছে।
মানুষ এখন
সেটা বুঝতে
পারছে।
বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষার সংকটগুলো কী? এর
থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
ভেটেরিনারি
শিক্ষায় অন্য
বিষয়গুলোর মতোই
সংকট রয়েছে।
গবেষণা ও
দক্ষতানির্ভর উচ্চশিক্ষা
তৈরি করতে
হবে। এখন
১২-১৩টি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে।
কিন্তু সব
প্রতিষ্ঠানে সমান
দক্ষ জনবল
তৈরি হচ্ছে
না। এর
জন্য বিনিয়োগ,
দক্ষ শিক্ষক,
গবেষণা ও
সেবার ওপর
নির্ভর করতে
হবে। ব্যবহারিকের
ওপর গুরুত্ব
বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য ও
উৎপাদন শিক্ষার
মধ্যে সামঞ্জস্য
রাখতে হবে।
কারণ স্বাস্থ্য
ও উৎপাদন
একে অন্যের
সঙ্গে সম্পর্কিত।
দক্ষতা না
থাকলে কিন্তু
মানুষের গ্রহণযোগ্যতা
পাওয়া যাবে
না। এ
কারণে সবচেয়ে
বেশি দক্ষতার
ওপর গুরুত্ব
দিতে হবে।
মনিটরিং কর্তৃপক্ষ
লাগবে। যেকোনো
একটি প্রতিষ্ঠানের
মাধ্যমে এর
মনিটরিং নিশ্চিত
করতে হবে।
ভেটেরিনারিয়ানদের বিশেষায়িত কার্যক্রমে কিছু
ক্ষেত্রে দেখা
যায় সংশ্লিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের জনবল
থাকে না।
এটা কী
জনবল সংকট
নাকি ভেটেরিনারিয়ানরা অবহেলার শিকার?
কসাইখানা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিদর্শন করতে পারবেন শুধু ভেটেরিনারিয়ানরা। এটা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। কারণ একজন ভেটেরিনারিয়ান মাংস দেখলেই বুঝবেন এটায় সংক্রমণ আছে কিনা। কোনটা খাবারযোগ্য আর কোনটা খাবার অযোগ্য। এ দায়িত্ব মূলত স্থানীয় সরকারের। কিন্তু আমাদের দেশে সাধারণত প্রাণিসম্পদ থেকে কিছু মানুষকে নিয়ে তারা দায়িত্ব পালন করে। একজন মানুষ তো দুই কাজ করতে পারে না। এর জন্য আলাদা লোকবল লাগবে। লোকবলের অভাবের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিরও একটা পরিবর্তন আনতে হবে। এখন কিছু জায়গায় কসাইখানা তদারকিতে ভেটেরিনারিয়ানদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনটাই হওয়া উচিত। মিট ইন্সপেকশনের জন্য একটা পরিকল্পিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নতুবা এর জন্য মানুষের স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়বে। এখন নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে মিট ইন্সপেকশনের যে ব্যবস্থাপনা আছে এটা দায়সারা। এটাকে নতুন আঙ্গিকে শুরু করতে হবে।