আলোকপাত

জাতিসংঘকে অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে

মোহাম্মদ জমির

জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ অধিবেশনে মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস শুধু বিশ্বকে নানা সমস্যার বিষয়ে সতর্ক করেননি, সেই সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আলোকে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য শান্তি, মানবাধিকার এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে সবাইকে একত্রে কাজ করার বিষয়টি সামনে আনেন।

গুতেরেস উন্নয়নের ধাপগুলো, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাকে ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সংঘাত, জলবায়ুর পরিবর্তন, ভঙ্গুর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অসমতা এবং বিভক্তির ফলে প্রভাবিত হওয়ার দিকটি তুলে ধরেছেন।

এসব ক্ষেত্রে করোনা মহামারীর প্রভাবের বিষয়টি আমরা জানি, প্রসঙ্গে তিনি এমন এক দৃশ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেন, যেখানে নিউইয়র্কে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে সাধারণ অধিবেশন একটি উচ্চমাত্রার আয়োজনে রূপ নেয়। সে আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশ নেন।

বিশ্লেষক কেরি বয়েড অ্যান্ডারসন যথার্থভাবেই চলমান কঠিন সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কেননা সেখানে অংশ নেয়া ডেলিগেটদের পুরনো নতুন চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে হয়েছে। গত বছরের অধিবেশনের সময় থেকেই বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারীর নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে এবং তিনি ইউক্রেনে সৃষ্ট অশান্তির পরিণতিকে অনুভব করেছেন। ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে গুটিকয়েক বৈশ্বিক প্রবণতা এবং উন্নয়নগুলো বিশেষ করে স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের দিকে চাপ প্রয়োগ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তন এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতা দীর্ঘ সময়ের ঝুঁকিকে তুলে ধরছে, যা আর্থসামাজিক উন্নয়নকে পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য বদলে দিয়েছে। বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে। কাজেই কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের ভিন্নতা স্থায়িত্বের সম্ভাব্য প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ধারাবাহিকতা নিরসন এবং অভিযোজনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় জাতিসংঘের সদস্যদের অধিক মনোযোগ আশা করা যেতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন জনগণকে তাদের বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। যার প্রভাবে আক্রান্ত দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রমের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমের সহায়তা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। এটি নিয়ে আমরা কপ-২৭ সম্মেলনে অবিলম্বে বসব।

অন্য বিশেষজ্ঞরা সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বার্ষিক হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট (এইচডিআর) এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের (এইচডিআই) জরিপের কথা তুলে ধরেছেন। যেখানে দেখা গিয়েছে, গত ৩২ বছরের মধ্যে প্রথমবার ১০টি দেশের মধ্যে নয়টি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবন মানের অবনতি হয়েছে। 

সংগঠনটি যদিও অবনতির জন্য অনেক কারণ উল্লেখ করেছে। এক্ষেত্রে কভিড-১৯-এর প্রভাব বারবার ফিরে আসাকেই প্রধান কারণ হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। ইউএনডিপির ব্যবস্থাপক অ্যাকিম স্টেইনার এটিও দেখিয়েছেন মানব উন্নয়ন সূচক ২০১৬ সালের অবস্থানে ফিরে গিয়েছে এবং বিশ্ব নেতারা পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে অসহায় ভূমিকা পালন করেছেন। স্টেইনার পরিবর্তনের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পিছিয়ে যেতে পারে বলেও মনে করেন।

তাছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে জীবনযাপনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়া, বেকারত্ব, অধিক কাজ সম্পাদনের জন্য মানুষের চেয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি নির্ভরতার বিষয়টিও রয়েছে। এক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের যুগে কিছু দেশ মানসিক স্থিতাবস্থার ক্ষেত্রে দুমুখো তলোয়ারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থোনিও গুতেরেস জানান, বর্তমান সংকট মহামারী থেকে অসম অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং অসমতাকেই বাড়িয়ে তুলছে। ফলে এটি খাদ্য এবং জ্বালানির মূল্যবৃৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে, মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং দুর্বল দেশগুলোকে ঋণের দায়ে জর্জরিত করছে।

এর ফলাফল দক্ষিণ আমেরিকার অনেক উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এছাড়া ক্যারিবিয়ান দেশগুলো, আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এর ভুক্তভোগী। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান সূচকে খুবই নিচু অবস্থানে আছে, তাদের অবস্থান সাত ধাপ নিচে নেমেছে। এইচডিআইয়ের হিসাব মতে, দেশটি এখন ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৬১তম অবস্থানে আছে। যেখানে আফগানিস্তান ১৮০তম অবস্থানে রয়েছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদনটি পুরো বৈশ্বিক সমাজকে চিত্রিত করছে, যা সংকট থেকে সংকটে বিস্ময়করভাবে অভিভূত হচ্ছে।

স্টেইনার যোগ করেন, ঝুঁকিগুলো বঞ্চনা এবং অন্যায় বৃদ্ধির প্রতিই এগুচ্ছে এবং বিশ্বকে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করছে। আন্তঃসম্পর্কযুক্ত অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের বৈশ্বিক ঐক্যের ধারণাকে নতুন করে ভাবতে হবে।

অ্যান্ডারসনের মতো অন্যান্য বিশ্লেষক জাতিসংঘের মানব পাচার, শরণার্থী ইস্যু এবং বৈশ্বিক জনসংখ্যা সম্পর্কিত ভারসাম্যহীনতাকে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখিয়েছেন। অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোও বার্ধক্যে সংকুচিত জনসংখ্যার সমস্যায় ভুগছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় তরুণ এবং উঠতি জনসংখ্যা রয়েছে।

আগামী দুই অথবা তিন দশকে জনসংখ্যা হ্রাসের ক্ষেত্রে বিশ্ব উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উঠতি জনসংখ্যার মধ্যে বড় আকারের বৈষম্য দেখবে। বিস্ময়করভাবে জনসংখ্যাবিদরা অন্য একটি দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আফ্রিকা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করবে। যেখানে কিনা বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমে এসেছে। অ্যান্ডারসনের মতে, জাতিসংঘ এমন এক প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে যেখানে দেখা যাবে বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বর্তমান সময় থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকায় সংঘটিত হতে যাচ্ছে।

এটি কল্পনা করা যায়, রকম ভারসাম্যহীনতা এমন এক দৃশ্য তৈরি করবে যা অভিবাসনের দীর্ঘ এক প্রবাহের দিকে ধাবিত হবে। যেখানে মানুষ সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য এসব থেকে পালাতে চাইবে এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সুবিধার জন্য বিশ্বের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্তে যাওয়ার চেষ্টা চালাবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনসংখ্যাসংক্রান্ত পরিবর্তন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করবে, উন্নত দেশগুলোয় সস্তা শ্রমের চাহিদা তৈরি হবে। আবার অভিবাসন কাঙ্ক্ষিত দেশগুলোয় রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে সংকট ঘনীভূত হবে। আমরা এক্ষেত্রে এরই মধ্যে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডায় কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানের ফলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।

জাতিসংঘের উচিত আগামী দশকগুলোয় বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সামাজিক প্রয়োজন এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে চিন্তা করা, যা জাতিসংঘের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যেমনিভাবে বৈশ্বিক সহযোগিতার জন্যও প্রায়োগিক সমস্যার কারণ হবে।

সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় মানবাধিকারের অনুপস্থিতিতে মিয়ানমার, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তা অনুসন্ধানে শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শরণার্থী অভিবাসীদের বিষয়টি ব্যাপক আকারে বাড়তে পারে। জাতিসংঘ এসব বাস্তবতা নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু এটি অনেক কঠিন কাজ।

জাতিসংঘ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন যারা ধরনের সহযোগিতার কাজ করতে সক্ষম, যা বৈশ্বিকভাবে জনগণের অভিবাসনের বিষয়টি বোঝার জন্য প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে অভিবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠন (আইওএম), জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা, ইউএনডিপি, ইউএনএইচসিআর এবং ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের রিলিফ এবং ওয়ার্কস এজেন্সি রয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ গত বছরে লক্ষ করেছে কীভাবে জাতিসংঘের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় খুঁজেছে। কিন্তু তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন ব্যাহত হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করে অস্থিরতা তৈরি করছে এবং বিভিন্ন রকম অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর কাছে বসবাসরত জনসাধারণের নিরাপত্তা সংকট তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের উচিত তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগের বিষয়টি জোরদার করা, যেন তারা তাদের স্বদেশভূমিতে বাস করতে পারে।

জাতিসংঘের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ, সংস্থাটির বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য টেকসই ফান্ডের ব্যবস্থা করা। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই সংগঠনটির জন্য বৃহৎ দাতা হিসেবে ভূমিকা রাখে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় তার প্রশাসন জাতিসংঘের জন্য বিশেষ করে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নির্দিষ্ট সংস্থাগুলোর জন্য অনুদান হ্রাস করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সহায়তায় সৌভাগ্যজনকভাবে সে অনুদানটি পুনরায় দেয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে বাইডেন একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে তার প্রশাসন চলমান সংকটগুলো অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। এতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বর্ধিষ্ণু চ্যালেঞ্জ এবং প্রয়োজন পূরণ করতে পারবে।

যখন জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন, ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা, অভিবাসন এবং অর্থায়নের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সে সময়ে অন্য বৈশ্বিক দিকগুলোও জাতিসংঘের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এর মধ্যে চলমান কভিড-১৯ মহামারী ভবিষ্যতের মহামারীগুলো ঝুঁকি, অনুন্নত দেশগুলোয় ভাইরাসের পরিবর্তনসংক্রান্ত ভ্যাকসিনের সহজপ্রাপ্যতা, নারী কন্যাশিশুদের অগ্রগতিতে বাধা, বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাত, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার, খাদ্যনিরাপত্তার অভাব এবং জাতিসংঘের স্থিতিশীল উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো রয়েছে।

 

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত; বৈদেশিক সম্পর্ক, তথ্য অধিকার সুশাসনবিষয়ক বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন