পর্যালোচনা

পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার উদ্যোগ সময়োচিত তবে তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে নয়টি নিত্যপণ্যের দাম  সাতদিনের মধ্যে ঠিক করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ১৬ সেপ্টেম্বর  জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের ১৬তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কথা বলেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বলেছেন, সাতদিনের মধ্যে দাম নির্ধারণ করে কার্যকরসহ অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পণ্যের মূল্যতালিকা টানানো বাধ্যতামূলক করা হবে। এছাড়া কারসাজি করে দাম বাড়ালে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। উল্লেখ্য, এর আগে গত ৩০ আগস্ট বাণিজ্য সচিব, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির উপস্থিতিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নয়টি নিত্যপণ্য যথাচাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, এমএস রড সিমেন্টের দাম বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) পক্ষ থেকে নয়টি পণ্যের ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম বেড়েছে শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে খোলা আটা ময়দা ৬৭ শতাংশ, প্যাকেট আটা ৬৪ এবং প্যাকেট ময়দা ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া দেশের বাজারে চিনির দাম এক বছরে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। একইভাবে এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে তা বেড়েছে মানভেদে ২৯-৩৯ শতাংশ। এমএস রডেরও একই অবস্থা। এক বছরে স্টিল স্ক্র্যাপের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ। দেশের বাজারে ৬০ গ্রেডের রড ১৫ এবং ৪০ গ্রেডের রড ১৬ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া সিমেন্টের দাম বেড়েছে এক বছরে ৩১ শতাংশ। সরকারের কতিপয় নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত মধ্যযুগের স্বেচ্ছাচারী সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির খাদ্যপণ্য, বস্ত্র, দাস-দাসী, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাজারদর বেঁধে দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

তবে মূল্য নির্ধারণ করে  দেয়ার ক্ষেত্রে একটা জটিলতা আছে। শুধু সয়াবিন তেল চিনির দাম বেঁধে দিতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাকি পণ্যের দাম বেঁধে  দেয়ার এখতিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের। ওই ঘোষণা আসতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। এরই মধ্যে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। দ্রুত জটিলতার অবসান জরুরি।

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুসরণ করে আসছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রথম অর্ধদশকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট জোর দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর, বিশেষ করে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সরকারগুলো মিশ্র অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন সরকারি-বেসরকারি খাত নিয়োজিত, তেমনি অধিকাংশ পণ্যের মূল্য মুক্তবাজার অর্থনীতি ক্রমবিকাশের ধারায় নির্ধারিত হলেও সাধারণ জনগণের স্বার্থে বেশকিছু পণ্যের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে আসছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি পুরোপুরি চালু থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমে যাওয়ার পর ওই পণ্যটির দাম যখন দেশের বাজারে কমছে না বা কমার পরিবর্তে দাম বেড়েছে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, দেশের বাজারে সে পণ্যের দাম এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে বেড়েছে, তখন নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিঃসন্দেহে সরকারের। মধ্যযুগে একজন স্বেচ্ছাচারী সুলতানও সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

মধ্যযুগে খিলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি (শাসনকাল ১২৯৬-১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ) প্রায় গোটা ভারতবর্ষে তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। তার বিশাল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নিরাপত্তা, বিশেষ করে মোঙ্গলদের আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য তাকে একটি বিরাট সেনাবাহিনী পুষতে হতো। বিরাট সেনাবাহিনীকে স্বল্প বেতনে পোষণ, সাম্রাজ্যের আর্থিক স্থিতিশীলতা উন্নতি এবং জনগণের সুবিধার জন্য আলাউদ্দিন খিলজি গম, বার্লি, চাল, চিনি, ডালসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য, বস্ত্র, দাস-দাসী, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাজারদর বেঁধে দেন।

আলাউদ্দিন খিলজি কেবল খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, দাস-দাসী, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি দ্রব্যের চাহিদা অনুসারে সরবরাহেরও ব্যবস্থা করেন। কম ফলন বা অন্য কোনো কারণে খাদ্য ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে দিল্লির উপকণ্ঠে এবং রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শস্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়। উৎপাদনকারীকে ১০ মণের অধিক খাদ্যশস্য নির্ধারিত মূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করতে হতো। এটি আমাদের কৃষকের কাছ থেকে কাটা-মাড়াই মৌসুমে সরকারের ধান-চাল গম কেনার মতো। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আলাউদ্দিন খিলজি প্রবর্তিত নিয়মের মতো আমাদের কৃষক নির্ধারিত পরিমাণের বেশি সব ধান-চাল গম সরকারের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য নন। দ্রব্যাদির সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দুর্ভিক্ষ জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় রেশনিং প্রথার প্রবর্তন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে রেশনিং প্রথার প্রবর্তন আলাউদ্দিন খিলজির অভিনব প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, দাস-দাসী, পশু এবং অন্যান্য দ্রব্যের সরবরাহ, বাজারদর পর্যবেক্ষণ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি সরকারি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এসব দপ্তরে ব্যবসায়ীদের তালিকাভুক্ত করা হতো। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পদবি ছিল দিউয়ান--রিয়াসাত এবং শাহানা--মান্ডি (আরসি মজুমদার: অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া) ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, আলাউদ্দিন খিলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মধ্যযুগের রাষ্ট্রনীতির অঙ্গনে অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। ব্যবস্থা কেবল তার প্রধান উদ্দেশ্য সাধনে (স্বল্প খরচে বিরাট সেনাবাহিনী পোষণ) সহায়তা করেনি, এটি জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও বৃদ্ধি করেছিল। শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলাউদ্দিন খিলজির বক্তব্য ছিল, ‘এটা আইনসংগত কি বেআইনি, তা আমি জানি না; যা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর এবং জরুরি অবস্থার জন্য আবশ্যক মনে করি, সে অনুসারেই আমি আদেশ জারি করি।

মধ্যযুগের একজন স্বেচ্ছাচারী সুলতানের সব ধরনের খাদ্যপণ্য অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো দেশের সর্বস্তরের জনগণের জন্য ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য অন্যান্য দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা যেকোনো সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এটি ঠিক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল জ্বালানির দামে উল্লম্ফন ঘটেছিল। তবে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে এসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকটা হ্রাস পেলেও দেশে এর প্রভাব খুবই সামান্য। উপরন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে এমন পণ্যের দাম দেশের বাজারে বেড়েছে। এর পেছনে যে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে তা বলা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। বিটিটিসির উপর্যুক্ত প্রতিবেদনে এর সত্যতা মেলে।

জনগণকে শুধু আমদানীকৃত পণ্য আকাশছোঁয়া দামে কিনতে হচ্ছে না, দেশীয় খাদ্যপণ্য যেমনচাল, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম অতি উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকার আশা করেছিল, সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সীমিত আকারে ওএমএস চালুর ফলে চালের দাম কমবে।

উল্লেখ্য, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় সরকার ৫০ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারকে বছরে কর্মাভাবকালীন সেপ্টেম্বর, অক্টোবর নভেম্বর এবং মার্চ এপ্রিল, অর্থাৎ পাঁচ মাসব্যাপী ১৫ টাকা কেজি দরে পরিবারপ্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল বিতরণপূর্বক খাদ্য সহায়তা প্রদানের  সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু এবং চাল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ক হার হ্রাস সত্ত্বেও কমেনি চালের দাম; বরং কোনো কোনো শ্রেণীর চালের দাম বেড়েছে। নতুন করে বেড়েছে ডিম, মুরগি সবজির দাম। 

গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের প্রকোপে দেশের মানুষের আয় কমেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিতস্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১অনুযায়ী, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। এর ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তথ্যানুসারে, করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক শতাংশ। কিন্তু করোনাকালে তা বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। দশমিক শতাংশ থেকে তিন গুণ বেড়ে এটি ২৮ দশমিক শতাংশ হয়েছে (যুগান্তর, সেপ্টেম্বর)

বলা হয়ে থাকে, ভারতে ব্রিটিশ সরকার যেমন আলাউদ্দিন খিলজির খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কাছে ঋণী ছিল, তেমনই সময়ে উপমহাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিভিন্ন সরকার তার কাছে ঋণী। আলাউদ্দিন খিলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তার রাজ্যের সাধারণ মানুষ যেভাবে উপকৃত হয়েছে, তা আকাশছোঁয়া নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সময়েও যেকোনো দেশের সরকারের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। তাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে সরকার কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এটি একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। তবে তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে সরকার কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সফল হোকএটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্যসচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন