মেরিটাইম শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নেভিগেটিং অফিসার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলাচলকারী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা করেন। এ পেশায় শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্র উভয়ই ব্যতিক্রমধর্মী; পড়াশোনা, চাকরি ও উপার্জন সমান্তরালে চলতে থাকে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সমুদ্রগামী জাহাজে স্থায়ীভাবে সমুদ্রগামী জনবল নিয়োজিত করা হয়; তবে বেসরকারি জাহাজে একেকবারে গড়ে নয় মাসের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়। দূরসমুদ্রে কর্মক্ষেত্র হওয়ার কারণে সেখানেই একটানা ২৪ ঘণ্টা আবাসন। যেকোনো সমুদ্রগামী জাহাজই নেভিগেশন যন্ত্রপাতি, প্রপালশন মেশিনারি, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপণসহ জরুরি পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, বিনোদন, রান্না ও খাদ্য পরিবেশন, পানি তৈরি, পয়োব্যবস্থা ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাসমান শহর।
আমাদের দেশে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনার এ ব্যতিক্রমধর্মী জনবল তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশ কয়েকটি। সরকারি খাতে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (চট্টগ্রাম, রংপুর, পাবনা, বরিশাল ও সিলেট) ও মেরিন ফিশারিজ একাডেমি (চট্টগ্রাম) এবং বেসরকারি খাতে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম একাডেমিসহ ছয়টি একাডেমি। এছাড়া ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে (চট্টগ্রাম ও মাদারীপুর) তৈরি করা হয় সমুদ্রগামী জাহাজের মেরিন ক্রু। সমাজ-সংসার থেকে দূরে, আগুন ও জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি একটানা যান্ত্রিক পরিবেশের কর্মক্ষেত্রে বসবাসের কারণে এক্ষেত্রে মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। একজন ক্যাপ্টেন বা চিফ ইঞ্জিনিয়ারের মাসিক বেতন-ভাতা ১২-৩০ হাজার ডলার (১০-২৫ লাখ টাকা)।
শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির চাহিদায় সব সময়ই থাকে মেধাবী, প্রশিক্ষিত, ইংলিশে পারঙ্গম, মানসিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন এবং দায়িত্বে নির্ভরযোগ্য ক্যাডেটকে নিয়োগ করা। আমাদের বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজবহরে (সরকারি ও বেসরকারি) রয়েছে প্রায় ৬৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ। রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার সিফেয়ারার (১১ হাজার মেরিন অফিসার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এবং পাঁচ হাজার মেরিন ক্রু)। বর্তমানে প্রতি বছর প্রশিক্ষণার্থী কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশের সব মেরিন একাডেমি থেকে মোট প্রায় ৫০০ জন মেরিন ক্যাডেট প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। উল্লেখ্য, অর্ধশতাব্দি ধরে বাংলাদেশী মেরিনাররা সারা বিশ্বে নিজেদের ‘ইতিবাচক মেরিন ইমেজ’
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যা কিনা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ‘পুঁজি’। সরকারি একাডেমিগুলোয় দুই বছরের প্রাক-সমুদ্র পর্বে আবাসিক ও রেজিমেন্টাল প্রশিক্ষণের (সব কিছুসহ) ফি ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা (এর আগে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা ছিল); এরপরে
সমুদ্রগামী জাহাজে, বেতনসহ এক বছরের অন-দ্য-জব প্রশিক্ষণ এবং এরপর একাডেমিতে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা শেষে একজন ক্যাডেট অর্জন করে প্রি-সি নটিক্যাল সায়েন্স বা প্রি-সি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সনদ এবং একই সঙ্গে ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স (অনার্স) ডিগ্রি। উল্লেখ্য, বেসরকারি মেরিন একাডেমি থেকেও ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ডেক অফিসারদের (নটিক্যাল) শিক্ষণ: ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স (নটিক্যাল)- ১২
মাসের সমুদ্র প্রশিক্ষণসহ ৪৮ মাসের কোর্স: নটিক্যাল সায়েন্স, নেভিগেশনাল ওয়াচ ব্যবস্থাপনা (জাহাজের নেভিগেশন এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব), যাত্রাপথ
প্রণয়ন বা চার্টওয়ার্কিং, রাডার ও হাই-টেক অনুষঙ্গের ব্যবহার, মেরিটাইম স্যাটেলাইটের সাহায্যে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা, জাহাজের ম্যানুওভারিং, মালামালের ব্যবস্থাপনা, ক্রু ব্যবস্থাপনা, দূষণ প্রতিরোধ, অগ্নি-প্রতিরোধ, লাইফবোট ব্যবহার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা।
সমুদ্রগামী জাহাজে ডেক অফিসারদের (নটিক্যাল) দায়িত্ব: প্রাথমিকভাবে ডেক অফিসাররা জাহাজের নিরাপদ নেভিগেশন বা পথপরিক্রমার দায়িত্বে থাকেন। উঁচুমাত্রার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে তারা অন্য নানা ধরনের দায়িত্বও পালন করে থাকেন। সেসবের মধ্যে থাকে নেভিগেশনাল ওয়াচ, পথপরিক্রমার পরিকল্পনা, চলমান অবস্থায় জাহাজের অবস্থান পর্যবেক্ষণ, রাডার/চার্ট ইত্যাদির মতো সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে জাহাজের গতি ও দিক নির্ধারণ ইত্যাদি। বন্দরে অবস্থানকালে ডেক অফিসাররা মালামাল খালাস/বোঝাইয়ের কাজের সমন্বয়ে নিয়োজিত থাকেন। এসব কাজে সার্বিক নিরাপত্তাও বিধান করে থাকেন। সর্বজ্যেষ্ঠ অফিসার হিসেবে ‘মাস্টার মেরিনার’
জাহাজের কমান্ডে নিয়োজিত থাকেন।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের (নৌ-প্রকৌশলী) শিক্ষণ: ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স (ইঞ্জিনিয়ারিং)- ১২
মাসের সমুদ্র প্রশিক্ষণসহ ৪৮ মাসের কোর্স: মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াচ ব্যবস্থাপনা (জাহাজের প্রপালশন এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব), জাহাজের
ইঞ্জিন এবং যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং পুনঃসংযোজন, বিদ্যুৎ প্রকৌশল, ইলেকট্রনিক প্রকৌশল, কন্ট্রোল প্রকৌশল, রেফ্রিজারেশন প্রকৌশল, ক্রু ব্যবস্থাপনা, দূষণ প্রতিরোধ, অগ্নি-প্রতিরোধ, লাইফবোট ব্যবহার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা।
সমুদ্রগামী জাহাজে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের (নৌ-প্রকৌশলী) দায়িত্ব: প্রাথমিকভাবে মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা জাহাজের নিরাপদ যান্ত্রিক পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। বিশেষত তারা জাহাজের কাঠামো সংরক্ষণ, প্রপালশন ইঞ্জিন ও সহায়ক যন্ত্রপাতির দক্ষ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন হয় উঁচুমাত্রার কারিগরি দক্ষতা। পাশাপাশি তাদের দায়িত্বে থাকে প্রপালশন ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতির তত্ত্বাবধান, রেফ্রিজারেশন সিস্টেম, বৈদ্যুতিক জেনারেটর ও যন্ত্রপাতির পরিচালনা ও সংরক্ষণ। সর্বজ্যেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ‘চিফ ইঞ্জিনিয়ার’
জাহাজের প্রকৌশল প্রধানের দায়িত্ব থাকেন।
উচ্চতর শিক্ষা ও পেশায় ক্রমোন্নতি
অন্য যেকোনো পেশার মতো এখানেও প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নেভিগেশনে অর্জিত সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি আন্তর্জাতিকভাবে যেকোনো দেশে স্বীকৃত। প্রশিক্ষণ চলে জাহাজে এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। নটিক্যাল এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় সর্বোচ্চ সনদ ‘ক্লাস ওয়ান ডেক অফিসার’
সার্টিফিকেট এবং ‘ক্লাস ওয়ান মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং’
সার্টিফিকেট নিয়ে, সুইডেনের ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিসহ, বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে (এমএসসি, পিএইচডি) প্রবেশ করা যায়। এ পেশায় উন্নতি বা প্রমোশনের বিষয়টা প্রায় অবিশ্বাস্য! সুবিশাল সমুদ্রগামী জাহাজের নেতৃত্বে মাত্র ২৬-২৭ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন বা চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে দেখে অবাক হয়ে যান অনেকেই। তারুণ্যের পেশা শুরু হয় প্রথম তারুণ্যে; গন্তব্যে পৌঁছনো যায় শেষ তারুণ্যেই! আবার সমুদ্র ছাড়ার অর্থ মোটেও সমুদ্র-বিদায় নয়। সমুদ্র-সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম/ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া যায় অনায়াসে। যেখানে কাজে লাগানো যায় সমুদ্র পেশায় লব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতা। এসব সুযোগ খুব বেশি বলেই সমুদ্র ছেড়ে দ্রুত অনেকেই ফিরে আসে নীড়ে!
এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই অনুমেয় যে, দেশের বিকাশমান নারী-পুরুষ সমৃদ্ধ তরুণ সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘মেরিটাইম শিক্ষা’
একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। এ পথে একদিকে অর্জিত হবে, নেতৃত্বের গুণাবলিতে সমৃদ্ধ সুনাগরিক এবং অন্যদিকে দেশ অর্জন করবে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা। অনন্য এ শিক্ষায় অর্থ ব্যয় মানে অর্থলগ্নী; বিনিয়োগের বিপরীতে লাভের অংক উল্লেখজনক গুণ বেশি। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে সূচিত ‘সুনীল অর্থনীতির’
চলমান পথপরিক্রমায় অন্যান্য ধারার পাশাপাশি ‘মেরিটাইম শিক্ষা’
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অন্যতম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনের পথে মেরিটাইম শিক্ষা উন্মুক্ত করবে ‘সুনীল অর্থনীতির স্বর্ণদুয়ার’।
ড. সাজিদ হোসেন
কমান্ড্যান্ট
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম