জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতায় ক্যাপটিভনির্ভর শিল্প

বদরুল আলম

দেশে গ্যাসের মজুদ কমে আসছে। ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানিও বন্ধ। জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে রেশনিংয়ের ভিত্তিতে। অবস্থায় জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের শিল্প-কারখানায় সরবরাহের জন্য স্থাপিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

শিল্প খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সংস্থান করে ক্যাপটিভ বা নিজস্ব উৎপাদনের ভিত্তিতে। খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহারে আগ্রহী নন শিল্পোদ্যোক্তারা। শিল্প খাতে ক্যাপটিভে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ পড়ে, জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে গড়ে ব্যয় হয় তার প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এখন ক্যাপটিভ খাতেও দেখা দিয়েছে জ্বালানি সংকট। সামনের দিনগুলোয় গোটা শিল্প খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, একদিকে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে আবার জরুরি অবস্থায় অতি ব্যয়বহুল জ্বালানি ডিজেল ব্যবহারের সুযোগও নেই। ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহ এখনো পুরোপুরি বন্ধ না হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা উড়িয়েও দেয়া যাচ্ছে না। সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার আর কোনো পথও খোলা নেই উদ্যোক্তাদের সামনে।

দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশের বেশি আসছে ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলো থেকে। সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১২ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই ছিল ক্যাপটিভের। পরের অর্থবছরে তা নেমে আসে ১৬ শতাংশে। ২০১৯-২০ শেষেও ক্যাপটিভ থেকে উৎপাদন হয়েছে মোট বিদ্যুতের ১১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২০-২১ শেষে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপটিভের অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ শতাংশে।

মোট উৎপাদনে অংশ কমতে থাকলেও ক্যাপটিভ খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে। ২০১৬ সালে ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ২০২০-২১ শেষে তা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াটে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন মূলত তৈরি পোশাকের কাঁচামাল সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী বস্ত্র শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, ক্যাপটিভনির্ভর শিল্প পরিচালনাকারীদের জন্য বাস্তবতা হলো তাদের জ্বালানি উৎস একটিই গ্যাস। এখন যে দামে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা সমন্বয় করা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় উৎপাদনে গ্যাস সংকটের নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠবে। খুব কম উদ্যোক্তারাই দুই ধরনের জ্বালানি উৎস ব্যবহার করেন। কাজেই ক্যাপটিভ ব্যবহারকারীদের জন্য গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলে উৎপাদন বন্ধ থাকবে। দুই-তিন মাস ধরে এক ধরনের অঘোষিত রেশনিং হচ্ছিল। এখন তা হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে। অবস্থায় ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট রূপরেখা থাকা প্রয়োজন।

মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, বাস্তবতা হলো জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা এখন বৈশ্বিক বিষয়। বিশ্বের কেউই এখন এর বাইরে নয়। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। আমরা যতক্ষণ যতটুকু পাই, ততক্ষণ ততটুকু সময় কাজের ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। স্ট্যান্ডবাই ডিজেল আছে। কিন্তু এটা জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে রাখা হয়। ডিজেলের ব্যয় অনেক বেশি। এটি ক্যাপটিভে গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। হয়তো গ্যাসে চলল উৎপাদনের ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ ডিজেলে। এখন গ্যাস যদি একেবারেই না থাকে, তাহলে উৎপাদন বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। গ্যাস সংকট যে হবে সেটা নিশ্চিত। কীভাবে আমরা মোকাবেলা করব, সেটা দেখতে হবে। উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটা কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে তা পরিকল্পনা করতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে হাজার ৭০০-এর বেশি শিল্প-কারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলোয় দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। গত বছরও অপচয়ের কারণ দেখিয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে আনতে চাইছিল সরকার। সেজন্য ক্যাপটিভে সরবরাহকৃত গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়। তবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আগের অনেক হিসাব-নিকাশই বদলে গিয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ চলতি সপ্তাহেই এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, শিল্প খাতকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। শিল্প খাত যাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায়, সেটিই সরকারের লক্ষ্য। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই সরকার জ্বালানি তেলসহ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা করেছে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম বড় উৎস তৈরি পোশাক খাত। খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্পের জ্বালানি পরিকল্পনা নির্ভর করছে সরকারের নীতিনির্ধারণের ওপর। বিদ্যুতে নিজস্ব উৎপাদনের জন্যও আমাদের সরকারের গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করতে হয়। জ্বালানি তেলে চালাতে গেলে লাভ-লোকসানের বিষয় চলে আসে। আবার এলএনজি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এটি আমদানি করতে হয়। আর তার জন্য ব্যবহার হয় রিজার্ভ। রিজার্ভ সমুন্নত রাখতে রফতানি বাড়াতে হবে। এটা করতে হলে কল-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। সামগ্রিকভাবে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের কিছু করার নেই। সরকারের নীতিনির্ধারণের দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

বস্ত্র পোশাক শিল্পের অন্যতম বৃহৎ গ্রুপ মাইক্রো ফাইবার। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অর্থ) . কামরুজ্জামান কায়সার বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা খুব শঙ্কিত। এলএনজি আমদানি এখন সুরক্ষিত নয়। এটা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শিল্পেও গ্যাস-বিদ্যুতের রেশনিং করতে হবে। ফলে উদ্যোক্তাদের কোনো পরিকল্পনা কাজে লাগার সুযোগ নেই। সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকছে না। শিল্প সচল রাখা হবে এমন উদ্যোগের প্রত্যাশা করে সরকারের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমরা খুব শঙ্কায় আছি। কয়েক মাসের মধ্যে সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করছি জ্বালানির জন্য রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ক্রয়াদেশ আমাদের আছে। কিন্তু এগুলোর জন্য কারখানা চালাতে যে জ্বালানি প্রয়োজন, তা নিয়ে ঝুঁকি শঙ্কার মধ্যে আছি। সরকারের নিশ্চয়ই চেষ্টা আছে শিল্প-কারখানাকে ভালো পর্যায়ে নেয়ার। সে ভরসায়ই আমরা বিনিয়োগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। এছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। জ্বালানি সরবরাহ না থাকলে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ক্যাপটিভ চালাই গ্যাসে। চাপ না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। জ্বালানি ছাড়া আমাদের এক সেকেন্ডও চলবে না। এখন কোথাও যদি গ্যাস না থাকে, তাহলে উৎপাদন শতভাগ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের বিকল্প কিছু নেই। ক্যাপটিভ সক্ষমতা বস্ত্র শিল্পেই সর্বোচ্চ। আমরা এখন শুধু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যদি গ্যাস না থাকে, আমরা সবাই বসে যাব। পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। সরকার বলছে, যেসব এলাকায় শিল্প আছে সেগুলোকে লোডশেডিংয়ের বাইরে রাখা হবে বা সেখানে হলেও কম হবে। এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন