বৈশ্বিক মানদণ্ডের চেয়ে বাংলাদেশে ঋণখেলাপির পরিমাণ বেশি

আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের যে চিত্র উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বৈশ্বিক মানদণ্ডে ঋণখেলাপির হার - শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এটি দশমিক ৫৩ শতাংশ। তবে করোনাকালে ঋণখেলাপির পরিমাণ আরো বেড়েছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো হাতে পৌঁছেনি। যেকোনো দেশের অর্থনীতির চাকা সুচারুভাবে চালাতে সুস্থ সমৃদ্ধ ব্যাংক খাত আবশ্যক। গত তিন দশকে বাংলাদেশে অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতেরও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু সেই বিকাশ সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হয়নি। আশ্চর্যজনক হলো, ঋণ শোধ না করার পরও খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান, যেমন সুদ হ্রাস, মেয়াদ বৃদ্ধি প্রভৃতির সুযোগ দেয়া হচ্ছে। দেখা গেছে এসব সুবিধা পেয়ে তারা আর ঋণ শোধ করেন না। এতে যারা সঠিকভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ছে, এমনকি তাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ যে বাড়ছে তা বলাবাহুল্য। অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বস্তুত ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দ্রুত পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত।

খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন তা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। এছাড়া ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি অনিয়মের ফলেও খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা বাড়ছে, যা কঠোরভাবে রোধ করা প্রয়োজন। ঋণখেলাপিদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে ব্যাংক কোম্পানি আইন কঠোর করার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাপি ঋণের স্ফীত চিত্র দেশের ব্যাংক খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, সর্বোপরি অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অশনিসংকেত। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া। এছাড়া যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রদেয় নতুন ঋণও খেলাপির পাল্লা যে ভারী করছে নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। ঋণ যাতে কুঋণে পরিণত না হয়, ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর যতটুকু সতর্ক সজাগ থাকার কথা, তাতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে এরই মধ্যে বহুবার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একে আমলে নেয়া প্রয়োজন। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি সুশাসনের প্রভাব ব্যাংক খাতের অন্যতম সমস্যা। ঋণখেলাপি যাতে না হয়, সেজন্য বিদ্যমান নীতিমালার ব্যাপারেও নতুন করে ভাবতে হবে। গ্রাহকের আস্থা বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সুতরাং ব্যাংকারদের সৎ থাকা ছাড়া উপায় নেই। রাজনৈতিক পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত থেকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাংকাররা যাতে কাজ করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিশেষ বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। শুধু অর্থঋণ আদালতে এসব মামলার সময়মতো নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি নিয়েও ভাবতে হবে।

১৯৯৭ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দায় অঞ্চলের অনেক দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে থেকে বেরিয়েও আসে তারা। এসব দেশের অন্যতম থাইল্যান্ড। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেউলিয়া হয়ে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। একীভূতকরণের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় কমিয়ে আনে তারা। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত থাই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনকে (টিএএমসি) দেয়া হয় ঋণের শর্তে পরিবর্তন গ্রহীতার সম্পদ দখলে নেয়ার ক্ষমতা। করপোরেট ডেট রিস্ট্রাকচারিং অ্যাডভাইজরি কমিটি দায়িত্ব পায় খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়টি আদালতের বাইরে মীমাংসার। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উভয় প্রতিষ্ঠানই সাফল্য পেলেও টিএএমসির অর্জন লক্ষণীয়। প্রফিট শেয়ারিং পদ্ধতি টিএএমসির খেলাপি ঋণ আদায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। এতে খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে কমে আসে। ১৯৯৭ সালের আর্থিক সংকট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক ব্যাংক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যালান্সশিটে খেলাপি ঋণের অংক বাড়তে থাকে। অবস্থা থেকে উত্তরণে কোরীয় সরকার স্বল্পতম সময়ে পুরো আর্থিক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। নির্ধারিত ন্যূনতম মূলধন নেই, এমন দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বন্ধ করা হয় সেগুলোর কার্যক্রম। একীভূতকরণের মাধ্যমে বড় ব্যাংক গঠন করা হয়, যাতে ব্যাংকের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কমে আসে। আর এসব ব্যাংককে সরকারি সম্পদ কাজে লাগিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। উল্লেখযোগ্য ছাড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ কেনে কোরিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (কামকো) এরপর মুনাফায় সেগুলো বিক্রি করে সংস্থাটি। দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে যেগুলো তুলনামূলক ভালো ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছে, সেগুলোয় কোরিয়া ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের ইস্যু করা পাবলিক বন্ডের মাধ্যমে তহবিল জোগান দেয়া হয়। সুদের ব্যয় মেটাতে গ্যারান্টার হয় দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ার আর্থিক খাতের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলে এশিয়ার আর্থিক সংকট। এতে দেশটির মুদ্রামানে বড় ধরনের পতন ঘটে। মূলত দেশের বাইরে মূলধন চলে যাওয়া, সুদের হার বেড়ে যাওয়া এবং অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা দেখা দেয়াই ছিল এর কারণ। ফলে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। সমস্যা সমাধানে মালয়েশিয়ার সরকার প্রথমেই সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। আমানতকারীর তহবিল ফেরত দেয়ার পাশাপাশি সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য ১৯৯৮ সালে তিনটি নতুন সরকারি সংস্থা গড়ে তোলা হয়। পুনর্মূলধন জোগান, পুনর্গঠন অসচ্ছল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নজরদারিতে গড়ে তোলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ডানামোডাল। দায় পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ঋণদাতা গ্রহীতাদের জন্য করপোরেট ডেট রিস্ট্রাকচারিং কমিটি গঠন করা হয়। খেলাপি ঋণ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ডানাহার্টা নামে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে মালয়েশিয়া সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনা হয়। এতে খেলাপি ঋণের হার প্রত্যাশার চেয়েও কমে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপির পরিমাণ কমিয়ে আনতে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও কিছু আইন করেছে ঋণখেলাপি কমাতে। যেমন মানি লোন কোর্ট অ্যাক্ট, পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট, নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট। তার পরও ঋণখেলাপি সমস্যা বেড়েই চলছে। তবে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করার পদ্ধতিটি আধুনিক নয়। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ল্যাসিফিকেশন অব লোনস (সিএল) তৈরি করে, যার মাধ্যমে তাদের প্রদত্ত ঋণের শ্রেণীবিন্যাস সেই অনুসারে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পূর্ণ বা শতভাগ প্রভিশন কখনই রাখা হয় না। ফলে শুরু থেকেই এক ধরনের প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকগুলোয় বিরাজ করে। অথচ সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের কোনো ঋণ খারাপ হতে পারে এমনটা মনে হওয়া মাত্র তার বিপরীতে সম্পূর্ণ প্রভিশন রেখে দেয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে যদি সত্যিকার অর্থেই তা খেলাপি হয় এবং আদায় করা সম্ভব না হয় তাহলে যেন খেলাপি ঋণ খুব সহজেই অবলোপন করা যায়। কিন্তু মানসম্মত নীতির অনুসরণ আমাদের দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় একেবারে অনুপস্থিত, যা কাম্য নয়।

অনিয়ম বন্ধ করে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে কমিয়ে আনতে হলে ব্যাংক খাতে ঋণ প্রদান ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে হবে। খেলাপি ঋণ দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে চলে আসা এক পুঞ্জীভূত সমস্যা। তাই রাতারাতি এর সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। তদুপরি এটি এখন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কোনো একটি ব্যাংকের একার পক্ষে এখন আর তার খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় বিস্তৃত এক কর্মপরিকল্পনা।

খেলাপি ঋণের বিস্তার ব্যাংকগুলোকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করছে। ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রয়োজনে ব্যাপারে কঠোর আইন প্রণয়নের বিষয়টি ভাবতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে এবং তা ভবিষ্যতে আরো গভীর সংকট সৃষ্টি করবে। মনে রাখা দরকার, দেশে ব্যাংক খাতের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। অবস্থায় প্রধান কাজ হলো, সাধারণ মানুষ কিংবা গ্রাহকের আস্থা অর্জন করা। ব্যাংক খাতে দুর্নীতি নির্মূলের পাশাপাশি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে খেলাপি ঋণের বিস্তার রোধ অনাদায়ী ঋণ আদায়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন