বই পর্যালোচনা

মানবিক ও দার্শনিক চেতনানির্ভর এক দলিল

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

কি সাহিত্য কি দর্শন কি রাজনৈতিক ইতিহাসইত্যাকার বিভিন্ন ক্ষেত্রের সৃষ্টিকর্মের মূল প্রেরণা হলো প্রয়োজন তথা চাহিদা। এজন্যই জীবনযাপনের চাহিদা পূরণের জন্য মানবসমাজের সব বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীল উদ্ভাবন। জ্ঞানপিপাসু ডা. এমএ কাসেম অনূদিত মুর্শিদাবাদের নবাব-অন্তঃপুর: বেগমদের কাহিনী গ্রন্থটি তেমনই মানবিক দার্শনিক চেতনানির্ভর দলিল বটে।

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে (১৯৭২) অন্যতম স্বাক্ষরকারী, কুষ্টিয়া অঞ্চলের স্বনামধন্য চিকিৎসক সমাজসেবক এবং জ্ঞানপিপাসু  ডা. এমএ কাসেম  (সহ-অনুবাদক সুভাষচন্দ্র রায়) অনূদিত মুর্শিদাবাদের নবাব-অন্তঃপুর: বেগমদের কাহিনী শীর্ষক ইতিহাসনির্ভর গ্রন্থটি বর্তমানে সহজলভ্য হলেও মূল গ্রন্থ Begums of Bengal (১৯৪২) দুষ্প্রাপ্য বটে। উপমহাদেশের ইতিহাস সম্রাট স্যার যদুনাথ সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মূল গ্রন্থটি লিখেছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ছয় বেগমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। তারা হলেন যথাক্রমে মুর্শিদকুলী খানের মেয়ে জিনাত-উন-নিসা, আলিবর্দী খানের স্ত্রী শরফ-উন-নিসা, মতিঝিলের বেগম ঘসেটি বেগম, সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগম, সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুত্ফুননিসা বেগম, কোম্পানির মাতা মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগম প্রমুখ। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মুখবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন, তাদের জীবনী থেকে বাংলার মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন এবং পলাশীতে মুষ্টিমেয় ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর হাতে লক্ষ লক্ষ নবাব সৈনিকের পরাজয়ের প্রকৃত কারণ আমরা খুঁজে পাই। (পৃ: ৬৫)

সাধারণ বাঙালি পাঠকের কথা বিবেচনা করেই ডা. এমএ কাসেম গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন আজ থেকে প্রায় তিন দশক (১৯৯৩) আগে। অবশ্য তার লেখকসত্তা আবিষ্কৃত হয় তার মৃত্যুর (১৯৯৪) পরই। অনূদিত গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করে ঢাকাস্থ জাগৃতি প্রকাশনী, ১৯৯৬ সালে। বইটি অল্পদিনেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০২১ সালে মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করেন তার পাঁচ পুত্র (সম্পাদকমণ্ডলী), যারা সূর্যসন্তান, যথাক্রমে প্রকৌশলী আবুল হাসেম, অধ্যাপক . আবুল হুস্সাম, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ . আবুল বারকাত, চিকিৎসক ডা. একেএম মুনীর, কম্পিউটার বিজ্ঞানী নুরুল আজম।    

বর্তমান সংস্করণের গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে রয়েছে ডা. এমএ কাসেমের (১৯১৮-১৯৯৪) বর্ণাঢ্য জীবন কর্ম নিয়ে তার পাঁচ সূর্যসন্তানের ৪৮ পৃষ্ঠাব্যাপী সুদীর্ঘ ভূমিকা পর্ব। ডা. কাসেম পেশাগত জীবনে একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক হলেও তার সামাজিক পরিচিতি উচ্চতর জীবনদর্শনসহ ইত্যাকার বিষয়ে তিনি স্বনামেই খ্যাত ছিলেন। তার পাঁচ পুত্রসন্তান সম্পাদকমণ্ডলী হিসেবে লিখেছেন আমাদের মা-আব্বা: স্বরূপ সন্ধানে পুত্রদের অন্বেষণ শীর্ষক ৪৮ পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকা পর্বটি। তারা শুরুতেই (২য় অনুচ্ছেদ) ভূমিকার অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন এভাবে: আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল আমাদের মা-আব্বার স্বরূপ সন্ধানের কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। কিন্তু লেখনী ক্রিয়ার শুরুতেই দেখা গেল যে তাঁদের জটিল কঠিন জীবনসংগ্রামের কার্যকারণের ৯০ শতাংশই আমাদের অজানা। আর এসব জানতে দীর্ঘ সময় ধরে রীতিমতো গবেষণা করতে হলো। (পৃ.

অংশে স্থান পেয়েছে ডা. এমএ কাসেমের বংশপরিচিতি, উত্তরসূরি পরিচিতি, তার উচ্চতর জীবনদর্শন, লেখকজীবন, ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক কর্মকাণ্ড, ব্যক্তিগত জীবনে একজন পিতা একজন স্বামী হিসেবে তার দায়িত্ব-কর্তব্যবোধসহ ইত্যাকার বিষয়। এছাড়া রয়েছে তার মৃত্যুর আগে লিখিত অসিয়তনামা। এককথায় আলোচ্য অংশটিতে একদিকে ডা. এমএ কাসেমের দার্শনিক চেতনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তারই পাঁচ সূর্যসন্তান; অন্যদিকে এটি মানবিক দার্শনিক চেতনানির্ভর এক দলিলও বটে। যার দার্শনিক মূল্যমান মূর্ত রূপ লাভ করেছে অনায়াসে।

গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে মূল অনুবাদকর্মটি। অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদকদ্বয় যে দুটি ভাষায় পারদর্শী তা বলাই বাহুল্য। প্রসঙ্গে এটুকু বলা সংগত হবে যে সবাই অনুবাদকর্মে দক্ষতা দেখাতে পারেন না। দুটি ভাষাকে প্রাজ্ঞতা দিয়ে রপ্ত করতে পারলেই কেবল অনুবাদকর্মে সফলতা আসে। এদিক থেকে ডা. এমএ কাসেম সুভাষচন্দ্র রায় অনুবাদক সত্তা হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। অনূদিত গ্রন্থটির শিল্পরুচি শিল্পভাষা প্রশংসনীয় বটে। যেমন এক অনুচ্ছেদ থেকে পরবর্তী অনুচ্ছেদে অনুপ্রবেশ করতে অনুবাদের যে ভাষাশৈলী, শব্দ চয়ন বাক্য গঠন আবশ্যক, সেক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছন্দপতন হয়নি। অর্থাৎ এখানে সহজ-সরল ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে, তাতে কোথাও ছন্দপতন লক্ষ করা যায় না। বাংলা ভাষার প্রাঞ্জল রূপটি এখানে সহজেই দৃশ্যমান হয়েছে।

অনূদিত অধ্যায়গুলো পড়লে একজন পাঠকের মানসজগতে সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অন্বেষণের স্পৃহা আরো বাড়বে, বাড়বে নানামুখী জ্ঞানের পরিধিও। এতে পাঠক জানতে পারবে নবাব অন্তঃপুরের অনেক অজানা ঘটনা। তত্কালীন কয়েকজন বেগমকে নিয়ে আলোচনা তারই পরিচয় বহন করে।

প্রকাশরীতি সৃষ্টিকর্মের বিচারে আলোচ্য গ্রন্থটি অনুবাদ শিল্পের অন্তর্গত। মূল লেখক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনুবাদক ডা. এমএ কাসেম তাদের মানবজ্ঞান অভিজ্ঞতার মিশেলে এক সৃষ্টিশীল অনুভূতির প্রেরণায় অনুবাদের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে মূর্তরূপ দান করে বাঙালি মানস ফসলকে তুলে ধরেছেন অকপটে। যেকোনো জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের দৃশ্যমান (লিখিত) লীলাবিন্যাস হলো ইতিহাস। এতে পাঠক-গবেষকের মনের ভাব হূদয়ের স্পর্শ জড়িয়ে থাকে উল্লিখিত ঘটনাপ্রবাহের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য। সে কারণে ইতিহাসের এক মুখ থাকে অতীতের স্মৃতি মন্থনের দিকে, অন্যটি সমসাময়িক জীবনের প্রয়োজন সাধনের দিকে। আর দুই ধারার সঙ্গে সংযোগ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে ঐতিহ্যবোধ। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ঐতিহ্যবোধকে তুলে ধরতে চেয়েছেন অন্তঃকরণ দিয়ে। আলোচ্য গ্রন্থটিতে বর্ণিত মানবচরিত্রগুলো আজও বাঙালি পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে সর্বত্র বিরাজমান। অন্য কথায়, পারিবারিক ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র পর্যন্ত সর্বত্র একই চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে আজ একুশ শতকেও। অনুবাদক ডা. কাসেম এটাকেই ইঙ্গিত করে অনুবাদকের কথা এক জায়গায় বলেছেন, রুগী বিশ্লেষণ করেই আমি নবাবদের অন্দরমহলে ঢুকেছি। (পৃ. ৬৪)   

আলোচ্য গ্রন্থটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘেঁটে দেখা গেল কিছু দার্শনিক সত্য. দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কার্যকারণটাই হলো ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা; . মানবচরিত্রের সহজাত অশুভ প্রবৃত্তিগুলো অপরিবর্তিত থাকে। এই শ্রেণীর মানুষ ভুল স্বীকারের অজুহাতে ছদ্মবেশ ধারণ করে মাত্র। অনুবাদক এই চিত্রটিকেও রুগী বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন; . অশুভ শক্তি সংঘবদ্ধভাবে পরাক্রমশালী হলে সেখানে শুভশক্তির বিনাশ অনিবার্য; . কারো ফর্ম অব লাইফ বা যাপন প্রেক্ষাপটই নির্ধারণ করে দেয় তার চাহিদার মাত্রা কতটুকু। ভাষা দার্শনিক ভিটগেনস্টাইনের ফর্ম অব লাইফ মতবাদটি গ্রন্থে চমত্কারভাবে উপস্থাপন করেছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যা পাঠককুলকে বিমোহিত করবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

গ্রন্থে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সামগ্রিক রূপ উপস্থাপন প্রসঙ্গে বেগমদের  প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মূর্ত অবয়ব গঠনে প্রতিটি উপাদান সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথক পৃথক আলোচনা পর্বাকারে বিশ্লেষণ করেছেন। যাকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ ব্যবচ্ছেদও বলা যেতে পারে। গ্রন্থটি পাঠ শেষে সাধারণ পাঠককুলকে তাদের অজ্ঞাতসারে মানবিকতায় অনুপ্রাণিত করবে, উদ্দীপ্ত করবে তাদের চেতনাকে, প্রজ্বলিত করবে তাদের চলার পথকে। বাঙালি চিন্তাচেতনায় যে মানব মনস্তত্ত্ব, মানবমহত্ত্ব মানবমুক্তির কথা রয়েছে, সেগুলো যেমন এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে; ঠিক তেমনি ইতিহাসের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা অঞ্চলের অর্ধসহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সমন্বয়বাদী মানবতাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার বিষয়টি। গ্রন্থের অনন্যতা এখানেই নিহিত।

 

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম: প্রাবন্ধিক সাহিত্য সমালোচক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন