প্রায় দুই দশকের ভয়াবহতম বন্যা

সিলেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৬০ মিটার বাঁধ

নূর আহমদ, সিলেট

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছে সিলেট অঞ্চলের বড় একটি অংশ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সিলেটের বিরাট অংশ। ১১ মের পর সাতটি উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়।  পাহাড়ি ঢলের চাপ নিতে পারেনি সিলেটের সুরমা কুশিয়ারার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো।

ঢলে নদীতীরবর্তী ডাইকগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকা জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বয়ে গিয়েছে প্রধানতম দুটি নদী সুরমা কুশিয়ারা। চলমান বন্যায় দুটি নদীতীরবর্তী ডাইক ৩৮ জায়গায় ভেঙে যায়। এতে মোট হাজার ৮৬০ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর আগে ২০০৪ সালে বড় বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল সিলেট। তবে এবারের পরিস্থিতি সে সময়কে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবার একটানা ১০ দিনের বেশি পানিবন্দি ছিল জেলার একটি বড় অংশের মানুষ। পানিতে ভেসে গেছে প্রয়োজনীয় সামগ্রী, মালামাল, আসবাবপত্র। দেখা দিয়েছে খাবার সুপেয় পানির তীব্র সংকট। বানভাসি মানুষের দুর্দশা অবর্ণনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জের বারোঠাকুরী অমলশীদ এলাকার বরাক মোহনায় সুরমা-কুশিয়ারা উৎসস্থলে ত্রিগাঙের ডাইক (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) এরই মধ্যে কিছু স্থানে ভাঙন বন্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে এখনো কাজ করছে পাউবো।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে দেখা গিয়েছে, জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর ১১ জায়গায় ডাইক ভেঙে ৭০০ মিটার এবং কুশিয়ারা নদীর বিয়ানীবাজার অংশে চারটি স্থানে ডাইক ভেঙে ১৪০ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জকিগঞ্জের সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪০ মিটার কানাইঘাট অংশে সুরমা নদীর ১১ জায়গায় ডাইক ভেঙে ৩৯৫ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিয়ানীবাজার উপজেলায় সুরমা নদীর এক জায়গায় ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫ মিটার। দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় সুরমা নদীর তিন জায়গায় ডাইক ভেঙে এক হাজার মিটার, সিলেট সদর উপজেলায় সুরমা নদীর এক জায়গায় ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ মিটার। জৈন্তাপুর উপজেলার সারি নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্লুইস গেটের রেগুলেটর ভেঙে যায়। এছাড়া গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুরমা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি স্লুইস গেটের রেগুলেটর ভেঙে গিয়েছে।

শুধু যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙেই পানি প্রবেশ করেছে তা নয়। অনেক স্থানে বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পানি। এর মধ্যে জকিগঞ্জে ১৬, কানাইঘাটে ২৬, বিয়ানীবাজারে পাঁচ, দক্ষিণ সুরমায় চার, গোলাপগঞ্জের চার জায়গায় বাঁধের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়। এছাড়া জৈন্তাপুরে সারি-গোয়াইন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে পানিতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়ে সুরমা নদীর বামতীর কুশিয়ারা নদীর ডানতীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

বন্যার পানি বৃদ্ধির সময় বিচ্ছিন্নভাবে বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হলেও সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তোলে সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জের বারোঠাকুরী অমলশীদ এলাকায় বরাক মোহনায় সুরমা-কুশিয়ারা উৎসস্থলে ত্রিগাঙের ভাঙনের খবর। ১৯ মে রাতে বাঁধ ভেঙে জকিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।

এবারের বন্যাকে ভয়াবহ আখ্যা দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সম্পাদক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২০০৪ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যার চেয়ে এবারের বন্যা বড় স্থায়ী। এবার বিশেষ করে সিলেট নগরী প্রায় ডুবেই গিয়েছিল। প্রায় সাতটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা পানিবন্দি ছিলেন। গতবার এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, বন্যার্তরা বাসাবাড়িতে ফিরলেও এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, বন্যার স্থায়িত্ব কমাতে নগরীকে বাঁচাতে করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি। না হলে সিলেটবাসীর জন্য খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।

এবারের ভয়াবহ বন্যার জন্য পরিবেশরক্ষা কর্মীরা দায়ী করছেন বর্জ্য অব্যবস্থাপনাকে। পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমি সন্তান সিলেটের কর্মী শুয়াইব হাসান বলে, প্রতিদিন সুরমায় ফেলা হচ্ছে নাগরিক বর্জ্য। বর্জ্যে সুরমার তলদেশ কয়েক ফুট পর্যন্ত ভরে গেছে। এছাড়া সিলেট সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে মোট কতটি চর পড়েছে, তার হিসাব এখনো কারো কাছে নেই। প্রতি বছর উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসে বালি পলি। এতে প্রায় পুরো সুরমা নদী ভরাট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত শতাধিক স্থানে জেগে ওঠে ধু-ধু বালুচর। কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজারসহ অসংখ্য স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে শুকনো মৌসুমে সবজি চাষ করা হয়। এমনকি কানাইঘাটে সুরমার তীরে জেগে ওঠা চরে শীতকালীন সবজি চাষ করা হয়। ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের চাপ সামলাতে পারেনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এজন্যই এবারের বন্যা ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে ঢুকেছে বানের পানি। নদী খনন দ্রুত না করলে আগামীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারা নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় নদী এখন আর পানি ধরে রাখতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন পাউবো সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কারণে নদী উপচে সিলেট নগরসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে নদী ড্রেজিং হলে রকম অবস্থা আর হবে না। পাহাড়ি ঢলের চাপে ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামত করতে সময় লাগবে জানিয়ে কর্মকর্তা বলেন, এর মধ্যে বর্ষা মৌসুম চলছে। নতুন করে আবার বন্যা দেখা দিলে ভাঙা স্থান দিয়ে সহজেই পানি প্রবেশ করবে। এর জন্য ছোট ভাঙা বাঁধগুলোর মেরামতকাজ চলছে। এরই মধ্যে সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে দুটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান এসএম শহিদুল আলম। তিনি বলেন, মুহূর্তে নদী খননকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এবারের বন্যায় বাঁধ ভেঙে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন পাউবোর সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ। তিনি বলেন, ভেঙে যাওয়া ৩৮ জায়গার মধ্যে কয়েকটিতে ভাঙন বন্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে। অন্যগুলোতেও শিগগিরই কাজ করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন