আলোকপাত

দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি সর্বজনীন পরিকল্পনা

ড. শামসুল আলম

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে বাংলাদেশ যেখানে পৌঁছেছে, একটি রাষ্ট্রের এই পরিভ্রমণকে কি সফল বলা যাবে?

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জলবায়ু মোকাবেলার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, তা এক কথায় বলা যায়বিস্ময়কর। মাথাপিছু ৯০ ডলার দিয়ে শুরু করে বর্তমানে তা হাজার ৫৫৪ ডলার, যা প্রায় ২৮ গুণ।

মাথাপিছু আয় বাড়া মানে দেশের সম্পদ বেড়েছে এবং জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে হিসাবটা পাওয়া যায়। শুরুতে দেশের সম্পদের পরিমাণ ছিল বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বর্তমানে দেশজ সম্পদের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১১ বিলিয়ন ডলারে।

স্বাধীনতা অর্জনের শুরুতে দারিদ্র্য ছিল মোট জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ এরা ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। সেই থেকে বর্তমান অবস্থান বিস্ময়কর উত্থান ছাড়া আর কিছু নয়। এজন্য এই পরিভ্রমণকে আমি মনে করি, অনেক সফল, অনেক চড়াই বিপত্তি উতরে যাওয়া। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, ত্বরান্বিত হয়েছে গত ১৩ বছরে; ২০০৯ সাল থেকে। ২০০৯ সালের আগে আমাদের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে সময় লেগেছিল ২৪ বছর। গত ১৩ বছরে সেই আয় মাথাপিছু বেড়েছে আড়াই গুণ। অর্থাৎ এটা হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। কাজেই এই যে বিস্ময়কর অগ্রগতি, তা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে গত ১৩ বছরে। যখন আমরা স্বাধীনতা লাভ করি, তখন প্রত্যেক পাকিস্তানির আয় ছিল আমাদের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে আমরা সেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে গত ১৩ বছরে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছি যে, পাকিস্তান থেকে আমাদের মাথাপিছু আয় ৪৫ শতাংশ বেশি। কারণেই শুরুতে বলেছি, বর্তমান বাংলাদেশের উত্থান বিস্ময়কর। এর সঙ্গে আরো একটু যুক্ত করা যায়, তা হলোবাংলাদেশ স্বাধীনের পর ৮৪ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। বর্তমানে তা থেকে আমরা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।

স্বাধীনতার পর যে বিপর্যয় নেমে আসে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু যেভাবে কাজ শুরু করেছিলেন, তাও বিস্ময়কর। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। এসে মাত্র ২১ দিনের মাথায় তিনি দেশে প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জাতীয় বীর, জাতীয় নেতা জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫০-এর মার্চে। পাকিস্তানে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮ জুলাই ১৯৫৩ সালে। অর্থাৎ দেশভাগের ছয় বছর পর। অথচ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের ২১ দিনের মাথায় শুধু পরিকল্পনা কমিশনই প্রতিষ্ঠা করলেন না, চারজন সদস্যসহ অন্যান্য জনবলও নিয়োগ দিলেন। এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও তৈরি করলেন। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় সবকিছু ধ্বংস করেছে, দেশ পুরোটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে রেখে গিয়েছে। ব্রিজ, কালভার্ট, রেলসেতু, সড়কসবই অচল করে দিয়েছে। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা ছিল আমাদের দেশে। পাকিস্তানি হানাদাররা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সকালে শাপলা চত্বর এলাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যত টাকা-পয়সা, নোট ছিল, সব পুড়িয়ে দেয়। স্বর্ণসহ অন্যান্য মূল্যবান যা কিছু ছিল, তা সঙ্গে করে নিয়ে যায় তারা। অর্থাৎ একেবারেই শূন্য হাতে বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শুরুতেই জাতীয়করণ করেন এবং কৃষি উন্নয়নের ভিত্তির জন্য বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) প্রতিষ্ঠা করলেন। বিএডিসির পুনর্গঠন করলেন। বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করলেন। বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি হলো, যা আগে ছিল না। বিআরডিবি প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড পৃথক করলেন বিদ্যুৎ থেকে এবং আলাদা বোর্ড গঠন করলেন। মোট কথা বঙ্গবন্ধু দ্রুতগতিতে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন এবং একদম টাকা-পয়সা ছাড়াই। ভারত থেকে টাকা ছাপিয়ে এনে আমাদের অর্থনীতি চালু করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের টাকা এখানে সেখানে যা ছিল, তাতে সরকারের সিল দিয়ে চালাতে হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, পারমাণবিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শুধু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নয়, বহু জনবল নিয়োগ দেয়াটা ছিল কল্পনাতীত। কেননা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো অর্থকড়ি ছিল না।

স্বাধীনতার পরে মাত্র এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করলেন। সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে বাস্তবায়ন শুরু হলো। যদিও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ বঙ্গবন্ধু পাননি। এক বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি আত্মীয়-স্বজনসহ সপরিবারে শহীদ হলেন। জাতীয় নেতাদের জেলে ঘাতকরা হত্যা করল। তো, সেই পরিকল্পনা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত হলেও বঙ্গবন্ধু তা আর বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। এরপর যারা এলেন, তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ছুঁয়েও দেখলেন না। কারণ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে রাজনৈতিক আদর্শের কথা উল্লেখ ছিল, তারা সেই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। মানে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে সাজানো, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উন্নত করা অর্থাৎ যেসব কথা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হলো। সেই আদর্শ থেকে যারা ক্ষমতা দখল করল বা রাতের আঁধারে ক্ষমতায় এল, পরিকল্পনা থাকল বটে, তারা তা বাস্তবায়ন করল না। তার পর থেকে পরিকল্পনা প্রথাগতভাবে হয়েছে, যেমন১৯৮১ থেকে ১৯৮৫, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ পরিকল্পনা হয়েছে, তবে তা নামমাত্র। সেগুলো বাস্তবায়নে তত্কালীন সরকার আন্তরিক বা মনোযোগী ছিল না। ছিল না কারণে যে, তারা ক্ষমতা সংহত করতে বেশি ব্যস্ত ছিল। বিশেষভাবে বিদেশীদের সঙ্গে তাদের সমঝোতা সম্পর্ক তৈরি, রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলা, ক্ষমতার লড়াই ইত্যাদিতে তারা ব্যস্ত ছিল। ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, কেন্দ্রীভূত করা, ক্ষমতা হাতে নেয়াতা কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নয়। ষড়যন্ত্র, দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি করে তারা ক্ষমতা সংহতকরণে ৯০ সাল পর্যন্ত ব্যস্ত ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তারা চায়ওনি, মনোযোগও দেয়নি। সে কারণেই ১৯৭৫-এর মাথাপিছু আয় ২৩৮ ডলার যা ছিল, ১৩ বছর পর ১৯৮৮-তেও তা- থেকে গেল। তারা যেটুকু করেছে, তা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ যেভাবে বলেছে, সেইভাবে অর্থনীতি সাজাতে চেষ্টা করেছে; ওদের ভাষায় তা ছিল স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট অর্থাৎ কাঠামোগত সমন্বয়। কাঠামোগত পরিবর্তন হলো আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রদর্শিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। ১৯৯১ সালে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি প্রণীত হলেও তা প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। অর্থাৎ যে বছর সরকারের মেয়াদ শেষ হয়, সেই বছরই পরিকল্পনাটি প্রকাশিত হয়। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও বিশেষ কোনো আন্তরিকতা ছিল না। তখনো মূলত দেশের অর্থনীতি মাল্টি লেটারাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিগুলোর পরামর্শেই পরিচালিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম যে বার (২৩ জুন ১৯৯৬) জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেন, তার পরের বছর অর্থাৎ ৯৭ থেকে ২০০২ পর্যন্ত পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করলেন। সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি প্রধানমন্ত্রী মোটামুটিভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। সে সময় সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি ছিল ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত। মূল্যস্ফীতি কম এবং খাদ্যে প্রথমবারের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে সে সময়। এরপর ২০০১-এর অক্টোবরে নতুন সরকার এল। আওয়ামী লীগ সহযোগিতার পথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করল। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্র, কারসাজি করে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে হারানো হলো। ২০০১- যখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে, তারপর তারা পরিকল্পনা করাই ছেড়ে দিল। ২০০২ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো পাঁচসালা পরিকল্পনা ছিল না। ২০০২-২০০৯/১০ সাল পর্যন্ত কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল না, যা ছিল সংবিধানের ব্যত্যয়। সংবিধানের ১৫ ()-তে বলা আছে, রাষ্ট্র পরিচালিত হবে পরিকল্পনামাফিক। সেখানে মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার, যথাখাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা নিশ্চিতের কথা রয়েছে এবং - বলা রয়েছে যে, পাঁচ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতে পরিকল্পিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। পৃথিবীর সব উন্নয়নশীল দেশই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে থাকে। তবে বিগত সরকার যেটা করল তা হলোপিআরএসপি, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র নামীয় তিন বছরের কৌশলপত্র। কৌশলপত্র মানে স্ট্র্যাটেজি পেপার, প্ল্যান নয়। সেই কৌশলপত্রে প্রবৃদ্ধি কী হবে, বলা হলো না। কর্মসংস্থান কতটা হবে, বলা হলো না। মূল্যস্ফীতির সুনির্দিষ্ট টার্গেট ঠিক করা হলো না। অর্থাৎ পরিকল্পনা ছাড়া দেশ পরিচালিত হলো এবং তা বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওয়াশিংটন কনসেনসাসের ভিত্তিতে। এটা বিশ্বব্যাংক প্রণীত কৌশল ছিল। এটি বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে, পাকিস্তান গ্রহণ করেছে, আফ্রিকার কিছু দেশ গ্রহণ করেছে। আবার পৃথিবীর বহু দেশ তা গ্রহণ করেনি। মোটকথা, ওই সময়টায় দেশ পরিকল্পনাহীনভাবে পরিচালিত হয়েছে।

জানুয়ারি ২০০৯ সালে যখন জনগণের বিপুল ভোটে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলেন। তিনি নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, আমাদের একটি রূপকল্প থাকবে। বাংলাদেশের বয়স যখন ৫০ হবে (সুবর্ণজয়ন্তী), তখন আমরা স্বাধীনতার জন্মজয়ন্তী পালন করব। সেই সময় বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই, তিনি সেই রূপকল্পে সেভাবে বলেছিলেন। যেমনরূপকল্পে ২০২১- ছিল, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হব, ২০১৫ সালে প্রবৃদ্ধি শতাংশে নিয়ে যাব; অবশ্য এর আগে বাংলাদেশের প্রবৃত্তি বা . শতাংশের বেশি কেউ দেখেনি। প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা শতভাগে নিয়ে যাব। ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব এবং আমাদের গড় আয়ু নিয়ে যাব ৭০ বছরে; যদিও আমরা এটা ৭৩- পৌঁছাতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী তার দূরদৃষ্টি, লক্ষ্য-অভীষ্ট ঠিক করে পরিকল্পনামাফিক দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পরিকল্পনার সঙ্গে আমি নিজেও ২০০৯ সালে এসে যুক্ত হই, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য হিসেবে। আমার ওপর অর্পিত হলো দেশের পরিকল্পনার ভার, বিশেষ করে ২০২১ পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেটাকে বলা হয় পারস্পেক্টিভ প্ল্যান বা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। এটি আমরা প্রণয়ন করি এবং ওই লক্ষ্যগুলো আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় সন্নিবেশিত করি। মোটা দাগে বলেছি, ২০১৫ সালের মধ্যে প্রবৃদ্ধি শতাংশে নিয়ে যাব, মধ্যম আয়ের দেশ হব, মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনব, ৪০ শতাংশ থেকে দারিদ্র্য কমিয়ে আমরা ২০ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ হতদরিদ্র আমরা বা দশমিক শতাংশে নিয়ে আসব।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার (২০১০-২১) রূপকল্প ২০২১ সালে বাস্তবায়ন হলো। এর ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পূর্ণ বাস্তবায়ন হলো এবং পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে দেশ বড় রকমের অগ্রগতি অর্জন করল। কভিড-১৯- আক্রান্ত হওয়ার আগে প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ১৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এরপর কিছুটা কমে এসেছে। আমাদের শিক্ষার হার ৪৩ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি; যেখানে ভারতের শিক্ষার হার বর্তমানে ৬৬, পাকিস্তানে ৭০ শতাংশ। আমরা এসব কিন্তু করেছি দ্রুতগতিতেই। মাতৃমৃত্যুর হার যথেষ্ট কমাতে পেরেছি। ১৯৯১-৯২ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ছিল ৪৯৪ জন। সেখান থেকে বর্তমানে ১৬৫-তে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। শিশুমৃত্যুও কমানো সম্ভব হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের পরিবারের গড় আকার চারে এসেছে। এভাবে আমরা বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে নম্বরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে, শিক্ষার দিক থেকে, মাতৃমৃত্যু হ্রাসের দিক থেকে। এক যুগের অগ্রগতি অবশ্যই বিস্ময়কর অগ্রগতি।

এখন আমাদের মাথাপিছু আয় হাজার ৫৫৪ ডলার, যেখানে ভারতে হাজার ১৫৬ পাকিস্তানে হাজার ৫৫০ ডলার। মোটকথা, দক্ষিণ এশিয়ার সব সূচকে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মাথাপিছু আয়) বাংলাদেশ নম্বরে। ১৩ বছরে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তার কর্মসম্পাদনার সাফল্যের জন্য। আর এই যে সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে সর্বসম্মত, বাস্তবায়নযোগ্য আমাদের পরিকল্পনাগুলোর জন্য। এর মধ্যে ছিল প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এখন চলছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার কৌশলগত প্রস্তুতি (বর্তমানে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ) ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে হতদারিদ্র্যমুক্ত দেশ। এর মধ্যে আমরা আরেকটি কাজ করেছি, তা হলোআজ থেকে আরো ২০ বছর পরের বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন। অর্থাৎ ২০৪১ সালে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্য কী অর্জন করব; সেই সময় দারিদ্র্য কত থাকবে, বেকারত্বের হার কত থাকবে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপ কী হবে, আমাদের কৃষি ক্ষেত্রের ভূমিকা কী হবে, শিল্প খাতের ভূমিকা কতটুকু থাকবে ইত্যাকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরি করেছি; আর সেটা হলো ২০২১ থেকে ২০৪১ সময়ে। বিবর্তন বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্জন, যা রূপকল্পের সেই ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে আবার পুনরুত্থান। সেটি প্রমাণিত হয়েছে গত ১৩ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে। আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সাফল্যে।

আমি যে কথাগুলো বলেছি, আমাদের দ্রুত রূপান্তরের মূল ভিত্তি হলো, আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে থাকা। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, অভীষ্ট চিহ্নিত করতে পারা। প্রতি বছর কত কর্মসংস্থান তৈরি করব, কত মানুষ বিদেশে পাঠাব, আমরা বছর অনুযায়ী স্থির করেছি। যেমনসপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা লিখেছিলাম, আমরা প্রতি বছর ছয় লাখ মানুষকে বিদেশে কাজের জন্য পাঠাব। দেখুন, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আমরা বিদেশে কাজের জন্য পাঠিয়েছি গড়ে সাত লাখ কর্মী।

আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিকল্পনামাফিক। প্রতি বছরের প্রতিটি বাজেট ছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আর্থিক যোজনা। আমরা আর্থিক যোজনা দিয়েছি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেটি বার্ষিকভাবে বিন্যাস করে কোথা থেকে কত সম্পদ নেব, সেগুলো আবার বাজেটে প্রতিফলন ঘটাতাম।

বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় পরিবর্তনের মূল ভিত্তি হলো বাস্তবায়নযোগ্য সর্বজনীন নন্দিত পরিকল্পনা হাতে থাকা। আমাদের কোনো পরিকল্পনা নিয়ে নাগরিক সমাজে সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ পরিকল্পনাগুলো ছিল অত্যন্ত অংশগ্রহণমূলক। সরকারি-বেসরকারি, এনজিও, আন্তর্জাতিক এনজিও, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সংবাদকর্মীসবার মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পনাগুলো প্রণীত হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ ১০০ বছরের পরিকল্পনার কথা বলি, আমরা প্রথমে ২০৪১ সাল পর্যন্ত রূপরেখা অংকন করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ক্রমেই আমাদের জন্য স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে; তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, আমাদের নদীগুলো ভরে যাচ্ছে। এগুলো চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এক বছরের তথ্য দিয়ে বোঝা যায় না। কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই এটি মোকাবেলা করতে হয়। সেই কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে তিনিই একমাত্র নেত্রী, যিনি ১০০ বছরের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছেন। পরিকল্পনায় রয়েছে আমাদের দেশের সবাইকে সুপেয় পানির নিশ্চয়তা দিতে হবেশুকনো মৌসুম হোক আর বর্ষাকালই হোক, কৃষিকাজে সেচের জন্য যাতে পানির অভাব না হয় তা নিশ্চিত করা। নদীভাঙন রোধ করা। নদীভাঙনে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৫৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। নদীগুলো ক্রমে আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব। নিয়ন্ত্রণ মানে গতি রোধ নয়, প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখব। যমুনা নদী ১৪-১৬ কিলোমিটারের যে প্রশস্ত, তা সংকুচিত করে আমরা ১০ থেকে ১১ কিলোমিটারে নিয়ে যাব ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গভীরতা বাড়িয়ে, যাতে আমাদের ভূমি উদ্ধার সম্ভব হয়। যমুনাভিত্তিক অর্থনৈতিক বাণিজ্য করিডোর তৈরি করব।

জলবায়ুর যে বিরূপ প্রভাব, তা যেন সক্ষমভাবে মোকাবেলা করতে পারি। সারা দেশে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করব। আর এজন্য নদীগুলো নাব্য রাখব। পানি সংরক্ষণের জন্য আমরা জলাধার গড়ে তুলব। বর্ষাকালে পর্যাপ্ত পানি বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। আমরা বড় বড় নদীতে কিছুটা স্থানীয়ভাবে পানি আটকে রাখতে পারি। আটকানো মানে জমিয়ে রাখা। পানি যখন অক্টোবরের দিকে চলে যাওয়া শুরু করে, তখন আটকিয়ে তিন-চার মাস ধরে রাখা যায়। তাহলে শীতকালে কৃষিকাজে সেচের জন্য আর পানির অভাব হবে না। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা, ভূউপরিস্থ পানির মাধ্যমে কৃষিকাজ করা, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করাএসব লক্ষ্য নিয়েই ১০০ বছরের -দ্বীপ পরিকল্পনা তৈরি হলো। এখানেও একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ প্রথম একটি দেশ, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে অর্থাৎ এর কোয়ালিটি নষ্ট না করে, যেমনকৃষি ভূমি, গাছপালা সবকিছু যেন সুরক্ষা পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা। জলবায়ু মোকাবেলায় এটা আমাদের বড় ধরনের পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের ১০০ বছরের যে পরিকল্পনা, তাতে আমরা ৮০টির মতো বড় প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করব, যাতে শহরাঞ্চলগুলোয় বন্যা হবে না, অর্থাৎ কোথাও পানি আটকে থাকবে না। নদীভাঙন রোধ করা হবে। আর পানির জলাধার নির্মাণ করে প্রচুর পানি সংরক্ষণ করব। সেই পরিকল্পনা নিয়েই আমরা আগামীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিকল্পনা বর্তমান প্রজন্মের একটি শ্রেষ্ঠ উপহার হবে বলে আশা করি। ২০৪১ সালের পর বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর চাওয়া সোনার বাংলা যেখানে বেকারত্ব থাকবে না, ক্ষুধা বা দারিদ্র্য থাকবে না এবং মাথাপিছু আয় হবে ১৬ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আমরা পৃথিবীর অন্যান্য ধনী দেশের মতোই ধনী দেশে পরিণত হব। সোনার বাংলার পথচিত্র আমরা তৈরি করেছি।

২০৭১ সালে বাংলাদেশের বয়স হবে ১০০ বছর। তখন ৮৫ শতাংশ মানুষ হবে শহরবাসী। শহর আর গ্রামের পার্থক্য ঘুচিয়ে আনা হবে। শহরের মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, গ্রামের মানুষও একই রকম সুবিধা ভোগ করবে। পাইপের মাধ্যমে পানি যাবে, বিদ্যুৎ যাবে অর্থাৎ গ্রাম গড়ে তোলা হবে পরিকল্পিতভাবে। এখন যেমন এলোপাতাড়ি অবস্থায় আছে, তা আর থাকবে না। একটি একটি বাড়ি থাকবে না, সেগুলো বহুতল, যেমন আটতলা, ১০ তলা বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটা গ্রামের মানুষ থাকবে। বিল্ডিংয়ে প্রচুর স্পেস থাকবে এবং পেছনে গরু, বাছুর রাখার জন্য ব্যবস্থা থাকবে, ফসল মাড়াইয়ের ব্যবস্থা থাকবে। ওখানে বাজার থাকবে, স্থানীয় হাট বসবে আর সারাটা গ্রাম হবে কৃষি ভূমি এবং ফসল-ফলাদি, বনাঞ্চল গড়ে তোলা হবে।

পরিকল্পনার আলোকে বলা যায়, ১০০ বছরের বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে, যে বাংলাদেশের কথা আমাদের অনেকেরই এখনো চিন্তার বাইরে। আমরা সেই বাংলাদেশের পথ বা ভিত্তিই তৈরি করে যাচ্ছি আমাদের স্বপ্ন দলিল ২০৪১ বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর মাধ্যমে।

 

. শামসুল আলম: প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন