কভিডকালে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী ডেঙ্গু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

আল ফাতাহ মামুন

সঠিক ব্যবস্থাপনায় অপসারিত না হওয়ায় প্লাস্টিক সামগ্রী এডিসের প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠছে ছবি: সংগৃহীত

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় প্রতিদিনই দেশে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি মাসে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে করোনা মোকাবেলায় যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন ভয়াবহ হয়ে উঠছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় শতভাগই রাজধানীর বাসিন্দা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিডকালে নানা কাজে ব্যবহৃত ওয়ানটাইম প্লাস্টিক উপকরণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণত খাদ্য পানীয় পরিবহনসহ বিভিন্ন কাজে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার হয়। করোনাকালে ওয়ানটাইম প্লাস্টিক উপকরণের ব্যবহার বেড়েছে অনেক বেশি। মূলত সংক্রমণের ভয়ে এখন এসব সামগ্রীতে করে খাওয়াদাওয়া বেশি হচ্ছে। এমনকি রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোও এখন কাচের কাপের পরিবর্তে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের গ্লাস ব্যবহার করছে। ক্রেতারাও সংক্রমণ এড়াতে এগুলোতে চা-কফি পান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। কিন্তু সমস্যা হলো এসব উপকরণ ব্যবহারের পর সঠিক ব্যবস্থাপনায় অপসারিত হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ওয়ানটাইম প্লাস্টিক সামগ্রী। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এডিস মশার প্রধান প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে রাজধানীর নির্মাণাধীন ভবনগুলো। তারপর ছাদবাগান, ফুলের টব, টায়ার গ্যারেজে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে বেশি। নিয়মিত দৃশ্যের বাইরে কভিডকালে ব্যবহূত প্লাস্টিক পণ্যও ডেঙ্গুর উল্লেখযোগ্য প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল--এর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মশক সুপারভাইজার মো. ইব্রাহিম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের মশককর্মীরা ওয়ানটাইম উপকরণগুলো নিয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। এজন্য সাধারণ মানুষের অসচেতনতাই বেশি দায়ী। মানুষ ওয়ানটাইম গ্লাস, কাপ, প্লেট ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট জায়গায় ফেললে ধরনের সমস্যা দেখা দিত না। মানুষ চা বা পানি খেয়ে রাস্তাঘাটে এখানে-সেখানে ওয়ানটাইম গ্লাস ফেলে রাখে। আবার বাসাবাড়িতেও দেখা যায়, এসব প্লাস্টিক উপকরণ মানুষ জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। এমন এমন গলি দুর্গম জায়গায় ওয়ানটাইম কাপ, প্লেট ফেলা হয়, যেখানে অনেক সময় আমাদের স্প্রেম্যানরা ঢুকতেও পারেন না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল--এর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্প্রেম্যান মো. সাগর জানান, তিনি নতুন বাজার ব্রিজ এলাকায় লার্ভিসাইড ছিটানোর কাজ করেন। প্রতিদিনই সেখানে বিপুল পরিমাণে ওয়ানটাইম গ্লাস পাওয়া যায়। মানুষ চা খেয়ে এখানে-সেখানে এমনকি ড্রেনেও ওয়ানটাইম গ্লাস ফেলে রাখে। ডিএনসিসির অঞ্চল--এর নম্বর ওয়ার্ডের স্প্রেম্যান মো. জাকারিয়া বলেন, উত্তরা থানার পাশে কয়েকটি টি-স্টল আছে। সেখানে প্রতিদিনই অসংখ্য ওয়ানটাইম কাপ-গ্লাস পড়ে থাকতে দেখা যায়। আবাসিক এলাকায়ও যেখানে-সেখানে ওয়ানটাইম গ্লাস পড়ে থাকে।

দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করার পরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে না আসার বড় একটি কারণ হিসেবে এসব প্লাস্টিক উপকরণের কথা উল্লেখ করেন মশক সুপারভাইজাররা। তারা বলেছেন, এখন বর্ষার মৌসুম। বৃষ্টি হলে এসব প্লাস্টিকে পানি জমে এবং তিনদিন পরই সেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এত বিপুল পরিমাণ ওয়ানটাইম কাপ, গ্লাসের সবগুলোতে স্প্রে করা মশককর্মীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। দেখা গেল কোনো একটি স্থানের সব জায়গায় লার্ভিসাইড ছিটানো হয়েছে। কিন্তু কোথাও একটি কাপে পানি জমে আছে, যেখানে হয়তো ওষুধ পৌঁছেনি। ওই একটি কাপ থেকেই এডিস মশার প্রজনন হয়ে সিটি করপোরেশনের বিপুল কর্মযজ্ঞ ব্যর্থ করে দিতে পারে।

ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, রাজধানীর মধ্যে পুরান ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি। কভিডের সময়টাতে আমরা দেখেছি, প্লাস্টিক বর্জ্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সব বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয় না। যেমন কেউ জানালা দিয়ে দুই ভবনের মাঝের সংকীর্ণ জায়গায় ওয়ানটাইম কাপ ফেলল। সেখানে গিয়ে তো বর্জ্য অপসারণ সম্ভব নয়। আমরা যা পাচ্ছি, তার ভিত্তিতে দেখা গেছে, ওয়ানটাইম প্লাস্টিক বর্জ্য তুলনামূলক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর পরিমাণ কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে আলাদা কোনো পরিসংখ্যান এখনো করা হয়নি।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা নির্মাণাধীন ভবনগুলোকে বড় করে দেখছি। এডিস মশার লার্ভার ৬৫ শতাংশই পাওয়া যাচ্ছে নির্মাণাধীন ভবনে। কিন্তু ওয়ানটাইম কাপ, গ্লাস, বোতলএগুলোও ডেঙ্গুর বড় ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। জনসচেতনতাই পারে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। আমরা যদি ওয়ানটাইম কাপ, গ্লাস, প্লেটগুলো এখানে-সেখানে না ফেলে ময়লা ফেলার নির্ধারিত জায়গায় ফেলি, তাহলে পরিবেশ মানবস্বাস্থ্য দুটোই মারাত্মক ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন