সাতসতেরো

দেশে ই-কমার্স উদ্যোগ ও বণ্টন সমস্যা

মো. আব্দুল হামিদ

ভেবেছেন কখনোহাতের নাগালে চোখ ধাঁধানো অসংখ্য বিপণিবিতান থাকা সত্ত্বেও শিল্পোন্নত দেশের ভোক্তারা কেন অনলাইন শপিংয়ে আগ্রহী হয়? অনেক কারণেই সেটা হয়ে থাকে। তবে মূলত তারা মাধ্যম ব্যবহার করে সময় বাঁচানোর জন্য।

অর্থাৎ সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর বিভিন্ন শোরুম ঘুরে যাচাই-বাছাই করে পণ্য পছন্দ করার মতো পর্যাপ্ত সময় অনেকেরই থাকে না। তাছাড়া  নিকটস্থ কোনো উৎস থেকে কিংবা সশরীরে গিয়ে সেটা কেনার পরিস্থিতিও অনেক সময় থাকে না। অথচ পণ্যটা তার খুব দরকার। অবস্থায় সাধারণত তারা অনলাইন শপিংয়ের দ্বারস্থ হয়।

-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো অতি দক্ষতায় ন্যূনতম খরচে প্রত্যাশিত সেবাগুলো দেয়। ফলে ক্রমেই তাদের ব্যবসায়ের আওতা বাড়তে থাকে। এখন প্রায় সব পণ্যই অনলাইনে কেনাবেচা হয়। সে কারণে অ্যামাজন বা আলিবাবার সাইটে কী কিনতে পাওয়া যায়, সে প্রশ্ন না করে বরং এটা বলা ভালো যে কী পাওয়া যায় না?

এখন কথা হলো, আমাদের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় -কমার্স উদ্যোগ কি সফল হওয়ার কথা? না, আপাতদৃষ্টিতে সেটা হওয়ার কথা না। কারণ আমাদের ক্রেতাগোষ্ঠী এখনো দেখে-শুনে, স্বাদ-গন্ধ পরখ করে দরকষাকষির মাধ্যমে পণ্য কিনতে পছন্দ করে। শুধু পণ্যের কিছু ছবি দেখে বা বর্ণনা পড়ে নির্ধারিত দাম পরিশোধ করা অনেকের জন্যই কঠিন ব্যাপার।

তাছাড়া তরুণ যে গোষ্ঠী অনলাইন কেনাকাটার প্রতি ইতিবাচক, তাদের হাতে রয়েছে অফুরন্ত সময়। তারা বিশেষ কিছু কেনার সুযোগ পেলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে রীতিমতো উৎসবের আমেজে সেটা কিনতে ভালোবাসে। কেনাকাটা শেষে পছন্দের রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাওয়া এবং দীর্ঘ সময় আড্ডা দেয়া তাদের কাছে শপিংয়েরই অংশ বলে গণ্য হয়।

তাই আপাতদৃষ্টিতে দেশের প্রেক্ষাপটে -কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সফল হওয়ার কথা নয়। হয়তো সে কারণেই ইন্টারনেট সেলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়লেও সে রকম প্রভাব বিস্তারকারী -কমার্স সাইট এখনো দাঁড়ায়নি। এমনকি জায়ান্ট কিছু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত ফেইল করেছে। ক্রেতাগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এটা অস্বাভাবিক নয়। 

তার পরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশকিছু ফ্যাক্টর ইতিবাচক ভূমিকা রাখার কথা। তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মজীবনে প্রবেশের ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে (সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে) ডিজিটাল উদ্যোগের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন উদ্যোক্তাদের কাস্টমাইজড মার্কেটের কাছে পৌঁছার চেষ্টা, অর্গানিক পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি, তরুণ জনগোষ্ঠীর ট্রেন্ড ফলো করার প্রবণতা ইত্যাদি বিষয় কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

কিন্তু আগেই বলেছি, আমাদের দেশে -কমার্স উদ্যোগ শুরু থেকেই হোঁচট খেয়ে খেয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে গত বছর মহামারী শুরুর প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছিল, দেশে অনলাইন শপিংয়ের পালে বুঝি শিগগিরই হাওয়া লাগবে। সেক্ষেত্রে হঠাৎ অসংখ্য (অনলাইনভিত্তিক) ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারও উদ্ভব হয়। তারা নিজ এলাকার খ্যাতিমান পণ্যগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হন। ক্রেতাদেরও একাংশ লকডাউনে ঘরে বসে পণ্য কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

কিন্তু করোনাকালে এমন উদ্যোগগুলোর ফল বুঝি হিতে বিপরীত হয়েছে! কারণ বিক্রেতাদের নিজস্ব বণ্টন ব্যবস্থা নেই। ফলে তাদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় পার্সেল সার্ভিস দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর, যাদের সামর্থ্য ছিল সীমাবদ্ধ। তা দিয়ে বিদ্যমান ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ডেলিভারির কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু করোনাকালে রাতারাতি তাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। লকডাউন পরিস্থিতিতে বণ্টন চ্যানেল হিসেবে এমন থার্ড পার্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এমনকি একই শহরের মধ্যে কুরিয়ার, পার্সেল সার্ভিস রাইডারদের সহায়তায় পণ্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার ধারণা জনপ্রিয় হতে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে (যেমন সিলেটে) কুরিয়ার অফিস থেকে সংগ্রহ (পিক) করে পার্সেল বাসায় পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগও দেখা যায়। বাড়তি সেবা হিসেবে প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য বাসায় পৌঁছে দেয়ার ধারণা বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরা স্বভাবতই এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে নেয়। আয় অনেক বাড়লেও তারা অবকাঠামোগত সামর্থ্য কিংবা অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগে তেমন আগ্রহী হয় না। কারণ দীর্ঘমেয়াদে চাহিদা বজায় থাকবে কিনা, সে ব্যাপারে হয়তো তারা সন্দিহান ছিল। ফলে অফিস স্পেস, গুদাম, পরিবহন সামগ্রী কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে তারা উদাসীন রয়ে যায়।

কিন্তু মহামারীকাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় সেবাপ্রত্যাশীদের চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে তাদের গুদামগুলোয় ডেলিভারি পণ্যের মজুদের পাশাপাশি নানা ধরনের অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। আম লিচুর মতো মৌসুমি ফল বহনের বাড়তি চাপে তাদের সত্যিই নাভিশ্বাস অবস্থা। উল্লেখ্য, শীর্ষস্থানীয় পণ্য ডেলিভারি দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। একটা বইয়ের প্যাকেট ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছতে মাঝেমধ্যে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় নিচ্ছে! অথচ আগে এক থেকে দুদিনে সেটা পাওয়া যেত।

প্রত্যাশিত সময়ে পণ্য ক্রেতার হাতে না পৌঁছানো, ভুলক্রমে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া, প্যাকেট খুঁজে না পাওয়া, পণ্যের গুণগত (দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা অযত্নে হ্যান্ডেল করায়) মান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বারবার অভিযোগ করেও প্রত্যাশিত সাড়া না পাওয়া, পণ্য বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা থাকলেও অফিস থেকে সংগ্রহ করতে বলাএমন অভিযোগের মাত্রা দ্রুত বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শৌখিন (পরীক্ষামূলক) ক্রেতারা ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন।

সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, তারা প্রাপককে স্থানীয় অফিস থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে বলেই খালাস। করোনার মধ্যে বাসা থেকে বের হবে না বলেই তো তারা অনলাইনে অর্ডার করে! বিশেষ অনুরোধে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হলেও তার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে। সর্বোপরি পার্সেল ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অসদাচরণ সেবাগ্রহীতাদের খুবই বিরক্তির কারণ হচ্ছে। ফলে যেসব সুবিধা পাওয়ার আশায় ক্রেতারা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দিতে শুরু করেছিলেন, তার সাধ অনেকটাই মিটে গেছে। অনেকেই দ্বিতীয়বার ওই ভুল করতে চাইছেন না।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে ক্যাশ অন ডেলিভারি অফার দেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও দীর্ঘ সময় পরে পণ্য পৌঁছায় বিরক্ত হয়ে অনেকেই সেটা রিসিভ করছে না। ফলে সেই পণ্যগুলো বিক্রেতার কাছে ফেরত পাঠাতে পার্সেল কর্মীদের ওপর আরো চাপ বাড়ছে। বিক্রেতার পণ্য ডেলিভারি বাবদ ফোন-ইন্টারনেট-কুরিয়ার আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বেশ হতাশাজনক অবস্থা। তার ওপর একটা প্যাকেট মিসিং হলে তো গোটা মাসের লাভ শেষ!

তাছাড়া সেলফোন ফেসবুক পেজনির্ভর ব্যবসায় উদ্যোগ হওয়ায় অনেক প্রতারক এরই মধ্যে এখানে ঢুকে পড়েছে। অগ্রিম পেমেন্ট নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করা কিংবা নিম্নমানের পণ্য দেয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। ব্যাপারে বলতে গেলে সংশ্লিষ্ট ক্রেতাকে ব্লক করা হচ্ছে। এভাবে প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকেই চিরতরে অনলাইন শপিং থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েও তা আবার মুখ থুবড়ে পড়ছে।

অনলাইন শপিং নতুন এক প্রবণতা হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষেরই নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঠিক কোন আইনের আওতায়, কাদের কাছে প্রতিকার চাইবে, তাও অনেকে জানে না। ফলে বেশ অস্বস্তির মধ্য দিয়ে -কমার্স উদ্যোগগুলো এগিয়ে চলেছে। নীতিনির্ধারক সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়া দরকার। প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নসহ উত্থাপিত অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বন্দোবস্ত থাকা জরুরি। নইলে আস্থাহীনতা এমন এক সম্ভাবনাময় প্রক্রিয়াকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করবে।

শিরোনাম দেখে পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন যে সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত এক -কমার্স সাইটের (পণ্য সরবরাহে) বিস্ময়কর অফারের চেয়েও অবিশ্বাস্য দেরি কথা উল্লেখ করব। দুঃখিত, তাদের সমস্যা নিবন্ধের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ এখানে বলা হচ্ছে, যারা সময়মতো পণ্য সরবরাহে আন্তরিক হওয়ার পরেও বিদ্যমান বণ্টন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সেটা করতে পারছেন না। তাছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানটিকে আমার কেন যেন -কমার্স উদ্যোগ বলে মনে হয় না!

তেমনটা মনে হওয়ার কারণ কী? এক্ষেত্রে ছোটবেলার এক অভিজ্ঞতা বলে শেষ করি। তাহলে আশা করি বুঝতে সুবিধা হবে। সেটা হলো:    

আমরা ঈদ পূজা উপলক্ষে স্থানীয় মেলায় যেতাম। সেখানে একটা খেলা দেখে খুব অবাক হতাম। খেলোয়াড়দের প্রথমে একেকটা বালা (রিং) টাকা করে কিনতে হতো। তারপর নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে বৃত্তের মাঝখানে রাখা কিছু পণ্যের (সাবান, কোকের বোতল, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদির) দিকে সেটা ছুড়ে মারতে হতো। যার বালা গিয়ে যে বস্তুকে ঘিরে পড়ত, তাকে সেটা দিয়ে দেয়া হতো। অর্থাৎ টাকা দিয়ে ১০ টাকা বা আরেকটু দামি পণ্য জেতার সুযোগ! তবে বালাটা বাইরে পড়লে খেলোয়াড় কিছুই পাবে না! বড়রা অবশ্য সেটাকে জুয়া খেলা বলত।

বহুল আলোচিত সেই -কমার্স প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম দেখে আমার কেন যেন সেই খেলার কথা মনে পড়ে যায়। তাছাড়া এক্ষেত্রে শুধু যে সেই প্রতিষ্ঠান বা তার খ্যাতিমান ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডররাই দায়ী, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ সাধারণত তিন-চার মাসেও যারা পণ্য ডেলিভারি দেয় না কিংবা যাদের ব্যাপারে শত-সহস্র অভিযোগ নেট দুনিয়ায় ভাসছেএসব জানার পরেও আপনি সেখানে পণ্যের অর্ডার দিচ্ছেন। তার পরও নিজেকে সাধু ভেবে সব জায়গায় তাদের দুর্নাম করে বেড়াচ্ছেন!

যদি প্রশ্ন করি, আপনার উদ্দেশ্য কি খুব মহৎ ছিল? নিবন্ধের শুরুতে -কমার্স সাইটে পণ্য কেনার যেসব কারণ বলা হয়েছে, তা কি আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল? তবুও আপনি অর্ডার করেছেন, কেন? যদি লাইগা যায়, তাই না? আসলে আধুনিক ফরম্যাটের সেই বালা খেলায় কিছু টাকা ছুড়ে মেরেছেন। ওই প্রক্রিয়ায় লাভবান হলে নিজেকে বিজয়ী মনে হবে। কিন্তু ধরা খেয়ে অনেকেই তাদের নামে দুর্নাম করে বেড়ায়। মনে রাখতে হবে, এসব খেলায় শেষ হাসি কিন্তু আয়োজকরাই হাসে!

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক   মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন