অভিমত

শুল্কমুক্ত গাড়ি ও শুল্কযুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ড. শেখ মাহাতাবউদ্দিন

একজন মানুষের রাষ্ট্রের কাছে প্রাপ্য মৌলিক চাহিদাগুলো হলো: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের পাঁচটি ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে ওই রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলেন। খাদ্যে আমাদের দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করা হলেও অভুক্ত মানুষ যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। বস্ত্র বাসস্থানের অভাব অঞ্চলভেদে বিভিন্ন, তবে প্রকট নয়। চিকিৎসাসেবার নামে ব্যবসা যে হচ্ছে না, তা অস্বীকার করা অসম্ভব। সাধারণত যে মৌলিক চাহিদাগুলো একটি উন্নয়নশীল দেশে ব্যবসার আওতামুক্ত রাখা অতি জরুরি, তার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। যদি এবং কেবল যদি মানসম্পন্ন শিক্ষাকে ব্যবসার আওতামুক্ত রেখে সর্বস্তরে তা ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলেই একটি দেশ উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে আহরণ করতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা পিরামিডে এখন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। যা জাপান, কানাডা কিংবা আমেরিকায় নেই। একটি দেশকে উন্নত করতে হলে সময়ের সঠিক ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য একটি বিষয়। একথা অনস্বীকার্য যে যদি এই জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দেয়া না যায় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার সহজলভ্যতা এখন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পাসের হারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়েনি। বর্তমানে ৪৮ হাজার ৪৪৩ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পাসের পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এর ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। যে কারণে নীতিনির্ধারকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করে এর কার্যক্রমে স্বাভাবিকতা আনতে সচেষ্ট রয়েছেন, যদিও এর গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চশিক্ষার এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কল্পনা করা অলীক কল্পনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। 

একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বের সব দেশেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু বাংলাদেশে এর মধ্যে সিংহভাগই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আইইউবি, নর্থ সাউথ বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অর্থ ব্যয় করে একজন শিক্ষার্থী বিবিএ পড়ছেন, হয়তো এর অর্ধেক বা তারও কমে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করছে। ধরনের অসামঞ্জস্যের পাশাপাশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে অনিয়মের অভিযোগও কম নয়। একই সঙ্গে উন্নত দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক বিষয়ের ওপর ডিগ্রি দিলেও বাংলাদেশে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এসব অনিয়ম বা বঞ্চনার সমতা বিধানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এড়াতে পারে কিনা, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। অনিয়মগুলো পুঁজি করে অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যে এক ধরনের আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। আয়ের ওপর সরকার ট্যাক্স বসাতেই পারে এবং তা যৌক্তিক। কিন্তু সেই ট্যাক্স পরিশোধের জন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় বাড়ার অজুহাতে তা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, এটি হয়ে ওঠে অমানবিক। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনীদের সন্তানেরা যেমন পড়ে, তেমনি এখানকার সিংহভাগ শিক্ষার্থীই হলো অনেক পরিবারের স্বপ্নের একমাত্র সম্বল। যারা সংসারের হাল ধরবে ভেবে অভিভাবকরা তাদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার এই বাড়তি ব্যয় বহন করেন। তাদের ওপর এমন করের বোঝা চাপানো অযৌক্তিক।

ভাবতে অবাক লাগে যে দেশে জনপ্রতিনিধিরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় কোটি টাকার গাড়ি ক্রয় করতে পারেন, সে দেশেই অসম ব্যয়ের ভার বহন করে চলা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য ১৫ শতাংশ কর প্রদান করতে হবে। এটা কি ভাবা যায় যে বাংলাদেশের মতো একটা দেশের অর্থমন্ত্রী এমন একটি প্রস্তাব করেছেন, যা নিয়ে ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিলেন! অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তারা আশ্বাস পেয়েছিলেনউচ্চশিক্ষায় কর নয়! একদিকে মৌলিক চাহিদার ওপর কর বসছে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত গাড়ি, যা মৌলিক চাহিদা নয় কিন্তু তার পরেও ক্ষেত্রবিশেষে তা করমুক্ত! উল্লেখ্য, মৌলিক চাহিদার সহজলভ্যতা রাষ্ট্রের সফলতার নির্ণায়ক এবং তা করযুক্ত হওয়া আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। এসব শিক্ষার্থী যদি একযোগে ঘোষণা করে যে আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব না, করও দেব না, আমাদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করুন। তখন কী হবে, একথা কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেছেন? পারবেন কি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে? এরই মধ্যে অনেক মহলে এক অযৌক্তিক আলোচনা চলছে তা হলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে অনার্স উঠিয়ে দেবেন! স্বপ্নেও ভাবছি না এমন হোক কিন্তু যদি হয়ে যায় তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশাল শিক্ষার্থীদের কী হবে ভেবেছি কি আমরা? একে তো অসামঞ্জস্য এবং অস্বচ্ছ শিক্ষাব্যয়, তার ওপরে আবার ওই অসামঞ্জস্য অর্থের ওপরে নতুন এক করের বোঝা চাপানো যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই। বিশ্বের অন্যান্য দেশ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এমন উদ্ভট করের সন্ধান পাওয়া যাবে না। উন্নত দেশে সন্তানের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে মা-বাবার আয়কর থেকে শুরু করে সব করে ছাড় দেয়া হয় এজন্য যে ওই মা-বাবাকে তার সন্তানের ভরণপোষণ করতে হয়। এমনকি তাদের শিক্ষা বা চিকিৎসা ব্যয় মা-বাবার আয়ের ওপর নির্ভর করে। কারো মা-বাবা মাসিক কোটি টাকা আয় করলে তার সন্তানের ব্যয়ও ওই আয়ের সমানুপাতে বাড়বে। আবার কেউ সামান্য আয় করলে সামান্য খরচেই ওই কোটিপতির সন্তানের সমান সুবিধার শিক্ষা কিংবা চিকিৎসাসেবা পাবে। আমরা উন্নত হতে চাই কিন্তু উন্নত দেশের এসব নিয়ম গ্রহণ করতে চাই না।

দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি উচ্চশিক্ষার ব্যয় সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সহজলভ্য হওয়াও বাঞ্ছনীয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার কাছে কয়েকটি অনুরোধের মাধ্যমে লেখার সমাপ্তি করব।

. উচ্চশিক্ষার বিকাশের বাধা কর অনতিবিলম্বে বিলুপ্ত করে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করুন; . সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সমমানের এবং সুষম ব্যয়ের (সর্বনিম্ন) পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করুন। স্বল্প ব্যয়ে উন্নত মানের শিক্ষাই হোক আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার এক দৃপ্ত শপথ; . গবেষণায় সরকারি বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে সমান সুবিধা প্রদান করুন। কারণ প্রাইভেট কিংবা পাবলিক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই হোক না কেন, দিন শেষে এরা সবাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

 

. শেখ মাহাতাবউদ্দিন: বিভাগীয় প্রধান, পুষ্টি খাদ্য প্রকৌশল বিভাগ ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ডিএসসি, আশুলিয়া, ঢাকা, বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন