কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্থাপন করা প্রয়োজন

করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। উদ্যোক্তাদের করোনার আঘাত থেকে উত্তরণ আগামী বাজেটে তাদের প্রত্যাশা নিয়ে খাতভিত্তিক উদ্যোক্তাদের মতামত পরামর্শ জানার প্রয়াস নিয়েছে বণিক বার্তা। আজ প্রকাশ হলো এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টদের সংগঠন এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান-এর সাক্ষাৎকার। তার সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুরুল ইসলাম

করোনার ক্ষতি কাটিয়ে এভিয়েশন খাতকে টিকিয়ে রাখতে আগামী বাজেটে সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী? আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোনো দাবি রয়েছে?

কভিড পরিস্থিতিতে এভিয়েশন খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে আগামী বাজেটে সরকারের কাছে আমরা শূন্য ট্যাক্সের বাস্তবায়ন চেয়েছি। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হলে আমরা চাচ্ছি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন এর যন্ত্রাংশ যেন এয়ারলাইনসগুলো শূন্য শুল্কে ছাড় করতে পারে। কোনো অজুহাতেই যেন এটির ওপর অযৌক্তিক কর চাপিয়ে দেয়া না হয়। সেই লক্ষ্যে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট এসআরও জারি করার জন্য অনুরোধ করেছি। আমরা আরো বলেছি, যদি কখনো সন্দেহ তৈরি হয় যে আমদানি করা যন্ত্রাংশটি উড়োজাহাজের অংশ হতেও পারে আবার না- পারেসেক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি এওএবি সত্যায়ন করবে। এওএবি সার্টিফিকেট দেবে যে এটি উড়োজাহাজ বা হেলিকপ্টারের যন্ত্রাংশ। সেই সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে এনবিআর সেটিকে শূন্য শূল্কে ছাড় করবে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উড়োজাহজের জ্বালানির ওপর যে উচ্চ হার আরোপিত রয়েছে। সেজন্য আমাদের প্রায় ৩০% বেশি মূল্যে জেট ফুয়েল কিনতে হচ্ছে। সেই ট্যাক্সও আমরা কমিয়ে আনতে বলেছি। যাতে আন্তর্জাতিক রুটের জন্য আমরা যে মূল্যে জ্বালানি সংগ্রহ করি, অভ্যন্তরীণ রুটের ক্ষেত্রে দামটা তার কাছাকাছি থাকে।

এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অনুরূপ বেসরকারি এভিয়েশন অপারেটরদের জন্য কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সেবা স্থাপন করার সুপারিশ করেছি আমরা। বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থাকায় বিমান কোনো যন্ত্রাংশ আমদানি করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উড়োজাহাজে সংযোজন করে সচল করতে পারে। কিন্তু বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর ক্ষেত্রে কাস্টম হাউজ থেকে সেটা ছাড় করতে থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সে কারণেই এয়ারলাইনস, হেলিকপ্টার এমনকি কার্গো এয়ারলাইনসগুলোর জন্য একটি কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্থাপনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি আমরা।

উড়োজাহাজ, ইঞ্জিন যন্ত্রাংশ আমদানি সম্পর্কিত সব বিষয় একই এইচএস কোডের (চ্যাপ্টার-৮৮) আওতায় আনার বিষয়ে আপনারা দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এটি করা হলে কী ধরনের সুবিধা হবে এয়ারলাইনসগুলোর?

আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষত আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে কিন্তু এভিয়েশনের হাব তৈরি করতে চান। যার অংশ হিসেবে আমাদের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল হচ্ছে। কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। সেখানে সরকারি তরফ থেকে প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। সেই বিনিয়োগকে ফলপ্রসূ করতে হলে এয়ারলাইনস ইন্ডাস্ট্রি থাকতে হবে। সেই বিবেচনায় যদি বলি তাহলে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, যন্ত্রাংশ আমদানি শূন্য শুল্কযোগ্য। বাস্তবতা হলো আমরা যখন কাস্টম হাউজে যন্ত্রাংশ ছাড় করতে যাই, আমাদের বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়। উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ হওয়ার পরও সেগুলোর ওপর প্রচুর কর ধার্য করা হয়। যেটা আমাদের অপারেটরদের জন্য কোনোভাবেই সহনীয় নয়। একদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন আমাদের এভিয়েশন খাতটা আরো উন্নত হোক, কিন্তু মাঠপর্যায়ে আমরা বিপরীত চিত্র দেখছি।

যেহেতু, উড়োজাহাজের জন্য শূন্য শুল্ক ব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেহেতু উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশও কাস্টমস থেকে শূন্য শুল্কে ছাড় করার ব্যবস্থা করতে হবে। কাগজে-কলমে উড়োজাহাজ এর যন্ত্রাংশের ওপর শূন্য শুল্ক। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আমরা প্রচুর কর দিয়ে যাচ্ছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত আমরা ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছি।

করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর প্রায় তিন মাস ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ ছিল। চলতি বছরও টানা ২৫ দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। এটি এয়ারলাইনস খাতের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

করোনা মহামারীর কারণে গত বছর শুরুতে দুই মাসের অধিক সময় ফ্লাইট বন্ধ ছিল। এরপর চালু করা হলেও ফ্লাইট পরিচালনায় সারা বছরই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা সীমিত হয়ে গিয়েছিল। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আমাদের কোনো ধরনের ফ্লাইট কার্যক্রম ছিল না। এর পরও যখন ফ্লাইট শুরু হলো, তখন তা ছিল খুবই সীমিত। দ্বিতীয়ত, শর্ত ছিল ফ্লাইট পরিচালনা করা হলেও অর্ধেকের বেশি নয়। তবে সার্বিকভাবে এই যে ধাক্কাটা, সেটা কিন্তু দুই মাসব্যাপী নয়, বলতে গেলে সারা বছর ছিল। আর ২০২১ সালে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আবারো বছরের মার্চ-এপ্রিল থেকে একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কভিডের সময়টা এভিয়েশন খাত কিন্তু বিরাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এভিয়েশন খাত। কভিডের কারণে বিশ্বের অনেক নামি-দামি এয়ারলাইনস দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমরা যে টিকে আছি এটা বিরাট একটা সৌভাগ্য। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমরা কতদিন টিকে থাকতে পারব, সেই শঙ্কাটা আমাদের কিন্তু থেকেই যায়।

এভিয়েশন খাতের সংকটের সময়ে সরকারের কাছে আপনারা কী ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন?

খাতকে টিকিয়ে রাখতে সংকটের শুরুতে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব ছিল। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মোটামুটি একটা সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথমত, আমরা সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে বছরব্যাপী ল্যান্ডিং পার্কিং চার্জেসগুলো মওকুফ করার কথা বলেছিলাম। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই চার্জ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশাটা ছিল আরো কিছুদিনের। কেননা আমাদের সংকট কাটিয়ে উঠতে আরো দু-তিন বছর সময় লাগবে। বর্তমানে কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা যেন বাড়ানো হয়।

সার্ভিস সেক্টরের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে সহযোগিতা, সেখান থেকেও একটা সহায়তা দেয়া হয়েছিল। কারণ সার্ভিস সেক্টরের কার্যক্রম বিশাল। সে তুলনায় আমাদের এয়ারলাইনস কার্যক্রম খুবই সীমিত। ব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্কে আমরা কিছুটা সাপোর্ট পেয়েছি। কিন্তু সেখানেও আমাদের দীর্ঘমেয়াদি একটা সহায়তা প্রয়োজন।

বিমানের তেলের মূল্যের সমস্যাটা কিছুদিনের জন্য কমানো ছিল, সেটা আগের অবস্থায় আবার ফিরে গেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য তেলের মূল্যটা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। যেহেতু আমাদের অপারেটিং কস্ট বেশি, সেহেতু এটি সহনীয় পর্যায়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা হোক। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম দামে তেল দেয়া হোক, এটা আমরা চাই না। তবে অতিরিক্ত কর আরোপ করে যাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম বাড়ানো না হয়, সেটাই আমাদের দাবি।

কয়েক বছর ধরেই চার্টার্ড হেলিকপ্টার সেবার চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে গত বছর কভিডের সময় রোগী পরিবহনে বেসরকারি চার্টার্ড হেলিকপ্টারের অনেক চাহিদা বেড়েছে। খাতের জন্য আগামী বাজেটে আপনাদের কী দাবি রয়েছে?

আমাদের দেশে এয়ারলাইনস হেলিকপ্টার সেবার বয়স কিন্তু প্রায় একই। এয়ারলাইনস সেবার বয়স যদি ২৫ বছর হয়, হেলিকপ্টার সেবার বয়সও কিন্তু প্রায় ২০ বছর। আমাদের সমস্যা কিন্তু কমন। আমরা সম্মিলিতভাবেই এসব সমস্যার কথা সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছি। হেলিকপ্টার সেবা কিন্তু এখন বড় ইন্ডাস্ট্রি। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সেবা দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে। খাতে বিপুল কর্মসংস্থান হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স দেয়ার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব খাতে বড় অংকের অর্থ জমা হচ্ছেএসব হচ্ছে প্রত্যক্ষ অবদান। অন্যদিকে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশ থেকে বায়াররা আমাদের দেশে আসছেন। তাদের অনেকেই বিমানবন্দর থেকেই হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সরাসরি ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছেন। আরামদায়ক ভ্রমণের পর ফ্যাক্টরি দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তারা কিন্তু বড় অর্ডার দিয়ে ফিরে যান। এভাবে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের-রফতানি খাতকে হেলিকপ্টার সেবা বাঁচিয়ে রাখছে। দু-তিন বছরের আগের বাজেট থেকে প্রথমে ২০%, পরে ২৫% আর সর্বশেষ ৩০% সার্ভিস ডিউটিতে এসে ঠেকেছে। এর ওপর আবার রয়েছে ১৫% ভ্যাট। আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার করছি যে এই অতি উচ্চ হারে ট্যাক্স খাতে বিকাশের জন্য অন্তরায়। আমরা ভালো করেই জানি, কভিডের সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগী পরিবহন করা, জরুরি প্রয়োজনে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে হেলিকপ্টার সেবা কিন্তু বড় একটি অবদান রেখে যাচ্ছে। অবস্থায় হেলিকপ্টার এবং চার্টার্ড উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ এবং ভ্যাট মিলিয়ে যে ৪৫% অতিরিক্ত খরচ আরোপিত আছে, সেটি আমরা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে বলেছি। বিষয়ে এনবিআরকে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া আছে।

যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে প্রয়োজনআগামী বাজেটের জন্য এমন কোনো প্রস্তাব রয়েছে আপনাদের পক্ষ থেকে?

দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলের ক্ষেত্রে কেবল আকাশপথের যাত্রীদের ৭৩৮ টাকা ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। যেখানে ভাড়াই দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা, সেখানে ৭৩৮ টাকা কিন্তু একটা বিরাট ট্যাক্স। আমি মনে করি ট্যাক্সটা কমালে যাত্রী সংখ্যা বাড়বে। যাত্রী সংখ্যা বাড়লে সরকারের ট্যাক্সের খাতায় কিন্তু আরো বেশি অর্থ জমা হবে। অভ্যন্তরীণ রুটে এমবার্কেসন ফি, সারচার্জসহ আরো বিভিন্ন রকম খাত মিলিয়ে সরকার যে ৭৩৮ টাকা নিচ্ছে, সেটা কিন্তু টিকিটের দামের প্রায় ৩০ শতাংশ। দেশের অন্য কোনো সেক্টরে, সেটা রেল, বাস বা লঞ্চ হোক ধরনের অতি ট্যাক্সেশন কিন্তু কোথাও নেই। এটিকে যদি প্রায় ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামানো যায় অর্থাৎ ৭৩৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৪০০ টাকাও করা হয়, তাহলে কিন্তু যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। কম ভাড়ায় আমরা মানুষকে উৎসাহিত করব এয়ারলাইনসে ভ্রমণের জন্য। সর্বোপরি সরকারের কোষাগারে কিন্তু বেশি টাকা জমা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন