দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও কভিড পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক

বণিক বার্তা ডেস্ক

ভারতের কভিড পরিস্থিতি এখন এক প্রকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ এখন মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বিশ্বব্যাপী মোট দৈনিক সংক্রমণের অর্ধেকই এখন শনাক্ত হচ্ছে ভারতে। অন্যদিকে প্রতি চারজন মৃতের একজন ভারতীয়। দেশটিকে নিয়ে গোটা বিশ্বেই এখন মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সংক্রমিত হচ্ছে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। দেশটির উত্তরের প্রতিবেশী নেপাল হোক বা দক্ষিণের প্রতিবেশী শ্রীলংকা মালদ্বীপসবখানেই করোনা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এমনকি দূরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও এখন করোনা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হচ্ছে; বিশেষ করে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ইন্দোনেশিয়ায়। দেশগুলোর কয়েকটিতে এরই মধ্যে স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইতে বাধ্যও হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলংকায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি এরই মধ্যে আগের সংক্রমণ প্রবাহগুলোর চেয়েও খারাপ আকার ধারণ করেছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকালও দেশটিতে আগের ২৪ ঘণ্টায় হাজার ৯১৪ জনের দেহে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা এখন এপ্রিলের শুরুর দিককার তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।

দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী পবিত্র ওয়ান্নিয়ারাচ্চির বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, শ্রীলংকায় গত ১৩ ১৪ এপ্রিল নববর্ষকে কেন্দ্র করে উৎসবে প্রচুর মানুষ জমায়েত হয়েছিল। ওই সমাবেশ থেকেই দেশটিতে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

এর আগ পর্যন্ত দেশটিতে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে ধারণা করছিল দেশটির সরকার। এজন্য সে সময় দেশটির নাগরিকদের নববর্ষের উৎসবে যোগ দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছিল কলম্বো সরকার। এর পর থেকেই দেশটিতে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ২৭ এপ্রিল দেশটি ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাজার ১১১ জনের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানায়। গত বছর মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ওই দিন প্রথম দেশটিতে নতুন সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করার তথ্য জানায় দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি সব ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে কোটি ১০ লাখ মানুষের দেশটিতে শতাধিক স্থানে আরোপ করা হয় কঠোর লকডাউন। সম্প্রতি লকডাউনের আওতা বাড়ানো হয়েছে আরো চার জেলায়। বর্তমানে দেশটির ২৫টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যে ১৩টিতেই কঠোর লকডাউন চালু রয়েছে।

দেশটির সরকার মনে করছে, মুহূর্তে করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো টিকাদান। কিন্তু ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এখনো শ্রীলংকার লাখ ডোজ টিকার ক্রয়াদেশ পূরণ করেনি। ফলে দেশটিতে এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের টিকাদান নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দ্বীপদেশ মালদ্বীপেও করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রায়তনের দেশটিতে আগের ২৪ ঘণ্টায় ৭৬৬ জনের দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ হেলথ প্রটেকশন এজেন্সি। 

দেশটির অর্থনীতিতে পর্যটননির্ভরতা অনেক বেশি। তিন মাস লকডাউনের পর গত জুলাইয়ে দেশটি প্রথম অন্যদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। চলমান বৈশ্বিক মহামারীতে প্রথম সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া দেশও মালদ্বীপ। ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী মুহূর্তে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছে মালদ্বীপ। দেশটির রিসোর্টগুলোয় এখনো বলিউড তারকাদের পাশাপাশি ভারতের সংকট থেকে পালিয়ে পরিত্রাণ খোঁজা ধনীদেরও স্বাগত জানানো হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে বৃহত্তর মালে অঞ্চলে সান্ধ্য আইন জারি করা রয়েছে। সময় শুধু জরুরি প্রয়োজন ডেলিভারি সেবাসংশ্লিষ্টরাই বাইরে চলাচল করতে পারবেন।

অন্যদিকে হিমালয়কন্যা নেপালের অবস্থা এখন ক্রমেই ভারতের পর্যায়ে যাচ্ছে। দেশটিতে সংক্রমণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিলও। স্বাস্থ্য খাতও ভেঙে পড়ার পথে। অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্যান্য দেশের সহযোগিতাও চেয়েছে দেশটি।

দেশটিতে এখন প্রতি লাখে ২০ জন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতে পরিস্থিতি ছিল প্রায় দুই সপ্তাহে। এর আগে গত রোববার দেশটিতে মোট নমুনা পরীক্ষার ৪৪ শতাংশই কভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়। বিষয়ে নেপালে রেডক্রসের চেয়ারপারসন . নেত্র প্রসাদ তিমসিনা এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারতে এখন যা হচ্ছে, তা নেপালের ভবিষ্যৎ চিত্রের এক আগাম প্রদর্শনী। যদি আমরা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিকে থামাতে না পারি, তাহলে আমাদের প্রতি মিনিটে মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেড়ে যাবে।

নেপালে মাথাপিছু চিকিৎসকের প্রাপ্যতা ভারতের চেয়ে কম। এছাড়া দেশটির টিকাদান কার্যক্রমও এগিয়েছে বেশ ধীরগতিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, উৎসব বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণজমায়েত হওয়ায় দেশটিতে সংক্রমণ খুব দ্রুত ছড়াতে পেরেছে। এছাড়া দেশটির সরকারও নিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বেশ ধীরগতিতে।

এছাড়া দেশটির সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির জন্য ভারত থেকে আগতদেরও দায়ী করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অনেক ভারতীয়ই চিকিৎসার আশায় গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির খাতসংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে দেশটি ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি করোনায় বিধ্বস্ত এলাকাগুলোয় কঠোর লকডাউন আরোপ করে রেখেছে। এর মধ্যে রাজধানী কাঠমান্ডুও রয়েছে। এর পরও অনেকের আশঙ্কা, তা সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত নয়। কারণ বর্তমানে কাঠমান্ডুতে সংক্রমণ বেশ দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। এমনকি মাউন্ট এভারেস্টে পর্বতারোহীদের বেজ ক্যাম্প পর্যন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও করোনার সংক্রমণ এখন বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণ শুরুর পর চীনের বাইরে প্রথম ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছিল থাইল্যান্ডে। গত বছর দেশটি সংক্রমণ কমিয়ে রাখায় বেশ সফলতা দেখিয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর দেশটির জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামারীর তৃতীয় সংক্রমণ প্রবাহ। দেশটিতে সংক্রমণ শনাক্ত মৃতের সংখ্যা এখন ভয়াবহ আকারে বাড়ছে।

চলমান সংক্রমণ প্রবাহ শুরুর আগে থাইল্যান্ডে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল বেশ কম। মহামারী শুরুর পর থেকে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে মোট সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৮৬৩। কিন্তু এর পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই সংখ্যা ৭৬ হাজার অতিক্রম করে। সর্বশেষ গত শুক্রবার দেশটিতে হাজার ৯১১ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

দেশটির বিরোধীদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ওয়ায়ো আসাওয়ারাংগ্রুয়াং বর্তমানে নিজ দলের জনস্বাস্থ্যনীতি বিষয়ক দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি জানালেন ব্যাংককের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল এখন আগতদের করোনা পরীক্ষায় অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। কারণ এসব হাসপাতালে এখন বেডের সংখ্যায় টান পড়েছে। 

অন্যদিকে দেশটির সরকার এখন বিভিন্ন ক্রীড়াকেন্দ্র, কনফারেন্স হল হোটেলে করোনা আক্রান্তদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল বানাচ্ছে। এছাড়া টিকাদান কার্যক্রমের গতি বাড়ানোরও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

অঞ্চলের আরেক দেশ কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও এখন বেশ আশঙ্কাজনক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেশ সফলতার সঙ্গেই করোনার সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল দেশটি। ওই সময় পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে কম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া দেশগুলোর অন্যতম ছিল কম্বোডিয়া। এছাড়া ওই সময় পর্যন্ত দেশটিতে করোনা আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি।

কিন্তু ফেব্রুয়ারির পর থেকে পর্যন্ত দেশটিতে আশঙ্কাজনক হারে করোনায় সংক্রমণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত দেশটিতে মোট সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছিল মোটে ৫০০। জনস হপকিন্সের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজারে। অন্যদিকে সময়ের মধ্যে মৃতের সংখ্যা শূন্য থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪-তে।

গত এক সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ায় দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের গড় সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার। এছাড়া দেশটিতে সম্প্রতি করোনার উচ্চসংক্রমণশীল ভারতীয় ধরনও শনাক্ত হয়েছে। অবস্থায় আসন্ন ঈদে দেশটির সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কায় পড়ে গিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার সরকার। ওই সময় অনেকেই ছুটিতে নিজ কর্মস্থল থেকে পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে যাবেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কভিডের সংক্রমণ থামাতে ইন্দোনেশীয় সরকার গত বৃহস্পতিবার থেকে সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে ১৭ মে পর্যন্ত। সময়ের মধ্যে গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাস, ট্রেন, ফেরি, জাহাজ, উড়োজাহাজসহ যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করে এক জেলা বা অঞ্চল থেকে অন্যত্র ভ্রমণ করা যাবে না। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে পুলিশ সামরিক বাহিনীসহ দেড় লাখেরও বেশি নিরাপত্তা রক্ষাকারীকে মাঠে নামাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া সরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন