খাল ও নদী ভরাট হয়ে পড়ছে পলি জমে। এর প্রভাবে বনের ভূমির (ফরেস্ট ফ্লোর) উচ্চতা বেড়েছে দেড়-দুই ফুট। এ উচ্চতা পার হয়ে বনে ঢুকতে পারছে না জোয়ারের পানি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের শ্বাসমূলের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস। ব্যাঘাত ঘটছে বংশবিস্তারেও। অন্যদিকে বনের বাস্তুতন্ত্রের তোয়াক্কা না করেই উঁচু হয়ে পড়া এলাকায় রোপণ করা হচ্ছে কড়ই ও মেহগনি গাছ।
পূর্ব সুন্দরবন অঞ্চলের ছয় এলাকায় এখন এ দৃশ্য দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন এলাকায়। প্রত্যেক ভরা অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে যায়। কিন্তু এ ছয় এলাকায় তা হচ্ছে না। এসব এলাকায় ফরেস্ট ফ্লোরের উচ্চতা বেড়েছে প্রায় দুই দশক ধরে। এলাকাগুলোয় বর্তমানে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান গাছপালার উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে অনেক। অন্যদিকে জোয়ারের পানি আসতে না পারায় সুন্দরীসহ অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরাজির বংশবিস্তারও ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাঘাত ঘটছে পাতা ও গুল্মের পচন প্রক্রিয়ায়ও। বনের মাটিতে এসব পাতা ও গুল্মের আবরণ পড়ে এখন অগ্নিঝুঁকিও বাড়ছে।
ফরেস্ট ফ্লোর উঁচু হয়ে পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন কাটাখালি, ধানসাগর, গুলিশাখালী, নাঙলী, আমুর বুনিয়া ও শরণখোলা রেঞ্জের অধীন দাসের ভারানী। বন বিভাগ-সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে এসব এলাকায় জোয়ারের পানি উঠতে পারছে না। ফলে ব্যাহত হচ্ছে বনের সাধারণ বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে পাতাগুল্মের স্তর বেড়ে আগুনের ঝুঁকিও চরম মাত্রায় তৈরি হয়েছে। ফলে মৌয়াল বা অন্য কোনো উৎস থেকে সামান্য আগুনের আঁচ এলেই তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি। চলতি বছরেই পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় দুবার অগ্নিকাণ্ড হয়েছে।
সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে দাসের ভারানী এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়েছে ১০ একর বনভূমি। প্রায় চারদিন চেষ্টার পর এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ধারণা করা হচ্ছে, বনে জমে যাওয়া পাতা-গুল্মের আবরণের কারণে আগুন এতটা বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারলে এ আগুন ভয়ংকর রূপ নিতে পারত না বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, জোয়ারের পানি সুন্দরবনের ভেতর থেকে শুকনো পাতা ও লতাগুল্মগুলোকে নদীতে নিয়ে আসে। কিন্তু এ পানি বনে প্রবেশ করতে না পারলে এসব পাতা-গুল্ম শুকিয়ে জ্বালানিতে পরিণত হয়। কিন্তু বর্তমানে এসব এলাকার অনেক নদী ও সংযোগ খালে পানিই থাকছে না।
স্থানীয়রা জানালেন, দাসের ভারানী ক্যাম্প স্টেশন এলাকায় ফরেস্ট ফ্লোর এক-দুই ফুট উঁচু হয়েছে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে শুষ্ক মৌসুমে জোয়ারের পানি উঠছে না। এ বিষয়ে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আছাদুজ্জামান মিলন বণিক বার্তাকে বলেন, এখানকার পাতাগুলো এমন অবস্থায় থাকে, যেন সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই জ্বলে উঠবে। গত কয়েক যুগ ধরেই এ অবস্থার তৈরি হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই আগুনের ঘটনা ঘটতে দেখছি। যেন আগুনের মঞ্চ তৈরি হয়েছে। আগুন ধরলেও নেভানোর পানিও পাওয়া মুশকিল। ভোলা নদী বেশ কয়েক জায়গায় পানিশূন্য অবস্থা। ফলে আগুন লাগলে দ্রুত নেভানো যাচ্ছে না। এ অঞ্চলে সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্যের নানা দিক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বিস্তার ঘটে ক্রমাগমন (সাক্সেশন) প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে উজান থেকে বয়ে আনা পলিতে নতুন চর তৈরি হওয়ার পর পানিতে ভেসে আসা বীজ থেকে শুরুতে জন্ম নেয় কেওড়া গাছ। এর পরই ক্রমানুসারে সেখানে গেওয়া, বাইন ও সুন্দরী গাছের আগমন। আবার এসব গাছের গুল্ম ও পাতাগুলো পচন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা রাখে কাঁকড়া। এছাড়া এসব কাঁকড়া বনের মাটি ও পানির মান ধরে রাখতেও সহায়তা করে। কিন্তু সে কাঁকড়াও এখন বাণিজ্যিক চাষের মাধ্যমে তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু উল্লিখিত এলাকাগুলোয় এ চক্র ভেঙে পড়েছে।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই যুগের বেশি সময় ধরেই পূর্ব সুন্দরবনের বেশকিছু অঞ্চলে জোয়ারের পানি প্রবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি। ফরেস্ট ফ্লোর বেশ উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণেই জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারছে না। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবেশ করতে পারছে না বিধায় আবার এ অঞ্চলে সুন্দরবন-বহির্ভূত গাছপালাও জন্মাচ্ছে। সুন্দরবনের প্রকৃতিগত এ পরিবর্তন বনের পাশাপাশি বাস্তুসংস্থানে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। সুন্দরবনের এ অংশে কত জায়গাজুড়ে এ ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, তার জন্য একটি গবেষণা করা হবে। আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। কারণ সুন্দরবনের কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমছে ৪ থেকে ১৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। আবার ঢেউয়ের গতিবেগ কমে যায় ২৯ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত। এভাবে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা থেকে যুগ যুগ ধরে মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। কমিয়ে এনেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে লোনা পানিতে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রাণিজ, জলজ ও বনজ সম্পদ মিলিয়ে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আধার সুন্দরবন। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধিশালী একটি ইকোসিস্টেম, অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, নদীভাঙন, অবৈধভাবে বসতবাড়ি স্থাপন, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন ও বৃক্ষনিধনের কারণে সুন্দরবনে কমছে বনজ অংশ। ১৯৭৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে এ বনের আয়তন কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। বনে সুন্দরী গাছের উপস্থিতি কমেছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, সুন্দরবন হলো সমৃদ্ধ জলাভূমি। সেটি জোয়ারের সময় ডুবে যাবে এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। বিশেষ করে ভরা কাটাল বা অমাবস্যার সময় বনের ৭০-৭৫ শতাংশ এলাকা জোয়ারের পানিতে ডুবে যাবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতে বেশকিছু বাধা তৈরি হয়েছে, যার সিংহভাগই মানবসৃষ্ট। সংযোগ খালগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের প্রকৃতি নিজে নিজেই ঠিক করবে। কিন্তু মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রকৃতিকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিচ্ছি না। এতে তার বৈশিষ্ট্য বদল করছে, যা সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থানের জন্য হুমকি তৈরি করছে। তাই সুন্দরবনের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে এর স্বাভাবিক ধারা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। উজানে মিঠা পানির প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে নদী ও খালগুলোয় পানির প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।