শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই সচল কোচিং সেন্টারগুলো

নজরদারি বৃদ্ধি ও আইনি ব্যবস্থা নিক স্থানীয় প্রশাসন

চলমান করোনা মহামারীতে দীর্ঘদিন ধরে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। বর্তমানে সেগুলো খোলার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখন পর্যন্ত আসেনি। তার আগেই কোচিং সেন্টারগুলো কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিত্য আসা-যাওয়ার খবর মিলছে। সরকারি নির্দেশনার ব্যত্যয় বন্ধে এখনই পদক্ষেপ জরুরি।

সত্য যে, প্রলম্বিত ছুটিতে শিক্ষা খাতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কিছুটা পঠন-পাঠনে সক্রিয় রাখতে অনলাইন দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। অথচ প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত শক্তিশালী অনলাইন পরিকাঠামো না থাকা, অধিক ইন্টারনেট ব্যয়, টেলিভিশন স্মার্টফোনের মতো আবশ্যকীয় ডিভাইসগুলো বিশেষত নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে না থাকায় গৃহীত উদ্যোগের সুফল সব শিক্ষার্থী সমানভাবে পায়নি। এতে ডিজিটাল বিভাজনের বৈষম্যও যেমন ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ার একটা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেকেই হতাশায় ভুগছে। অনেকেই পরিবারে অসহিষ্ণু আচরণ করছে। কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়িত হওয়ার খবরও সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে আসছে। দীর্ঘকালীন অনিশ্চয়তায় অভিভাবকরাও নিজেদের ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে ভীষণভাবে শঙ্কিত। সুযোগটিই মূলত কাজে লাগিয়েছে কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষগুলো। অভিভাবকদের বুঝিয়ে ছেলেমেয়েদের তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত করে নিয়মিত কোচিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনস্বীকার্য যে অন্য খাতের মতো করোনা মহামারীতে কোচিং ব্যবসাও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক কোচিং সেন্টার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো কোনোমতে টিকে আছে, তাদের আয়ের পথ বন্ধ। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক টানাপড়েনে তারা। শিক্ষা আইনে নোট গাইড নিষিদ্ধ হলেও কোচিং সেন্টার অবৈধ নয়। আইনিভাবে বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব আয়ের পথ সন্ধানের অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই কোচিং সেন্টারগুলো যে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রশাসনের নজর এড়াতে সকাল ১০টার মধ্যেই অনেক কোচিং সেন্টার তাদের কার্যক্রম শেষ করার তথ্য উঠে এসেছে বণিক বার্তার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে। তদুপরি, আইন অনুযায়ী সন্ধ্যার পর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। দুঃখজনকভাবে তারা দিনেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এটিও আইনের পরিপন্থী বৈকি। বিষয়টি আমলে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রশ্নফাঁসে যুক্ততার অভিযোগসহ আগেও বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। প্রশাসনের তাত্ক্ষণিক অভিযানভিত্তিক তত্পরতা ছাড়া দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ খুব একটা নেয়া হয়নি। ফলে কোচিং ব্যবসাকে সুশৃঙ্খলায় আনা যায়নি। তাদের আজকের নিয়মের ব্যত্যয়কে পুরনো অভ্যাসের বাইরে দেখার সুযোগ নেই। সুতরাং কোচিং সেন্টারগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ যেতে পারে।

করোনার কয়েকটি কার্যকর নিরাপদ টিকাপ্রাপ্তির বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী আশার সঞ্চার হয়েছে। ব্যাপকভাবে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেক দেশই নতুন স্বাভাবিকতায় ফিরতে শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশও বৈশ্বিক প্রবণতার বাইরে নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষগুলো এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় করণীয় বিষয়ে একটি গাইডলাইনও তৈরি করেছে। ওই গাইডলাইনে প্রবেশমুখে ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা, তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বেঞ্চে বসার ব্যবস্থার মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আগামী ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার কথা উঠে এসেছে। তার আগেই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যবিধির পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

জাপানে প্রাথমিকভাবে অর্ধদিবস, সপ্তাহে তিনদিন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সপ্তাহ দুয়েক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পূর্ণোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। আমাদেরও এক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিতে এগোনো দরকার। অন্য দেশগুলো কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা করছে, সেগুলোও পর্যালোচনা করা চাই। এছাড়া ছুটিকালীন শিক্ষার্থীদের ক্ষতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও সুস্পষ্ট একটি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রয়াসে নতুন বাস্তবতায় শিক্ষা খাত পুনরুজ্জীবিত হবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন