পর্যালোচনা

প্রণোদনার ঋণ কতটা পেলেন প্রান্তিক কৃষক?

শওকত হোসেন

করোনা আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। অনেক জীবন। অনেকে স্বজন হারিয়েছেন। অনেকের জীবিকা হারিয়েছে। অনেকের আয় কমে গেছে। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। শহর ছেড়ে অনেকে চলে গেছেন গ্রামে (যেমন ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, তবে ভিন্ন কারণে), যাতে অন্তত বাসা ভাড়াটা সাশ্রয় হয়। 

সরকার প্রণোদনা দিয়েছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুসারে, দেশে ২ দশমিক ৮৬ কোটি কৃষক পরিবার। তার মানে প্রতি পরিবারের ভাগে পড়ে ১ হাজার ৭৫০ টাকা। কিন্তু এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। কৃষক এটি পাবেন ঋণ হিসেবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে। সরকার নির্ধারিত সুদহার ৯ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার ভর্তুকি দেবে প্রদত্ত ঋণের ওপর ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পুরো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ হলে ভর্তুকির পরিমাণ হবে ২২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ দশমিক ৮৬ কোটি কৃষক পরিবারপ্রতি গড়ে ৭৯ টাকা। এ টাকায় কী পাওয়া যায় এখন গবেষণার বিষয়। আর কোনো কৃষিঋণ বরাদ্দ না হলে কত পাবেন কৃষক? অশ্বডিম্ব।  

কোনো এক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সঞ্চালনের সুযোগ আমার হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাঁচটি জেলার বিভিন্ন অংশীজন যেমন কৃষক, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা, এমএফআই, এনজিও প্রতিনিধি, কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কৃষিসংশ্লিষ্ট পণ্য (যেমন সার, পেস্টিসাইড, ফিড) উদ্যোক্তা, কৃষি ও কৃষক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সেবা সংস্থা অংশ নিয়েছিল। আমাদের সভা হয়েছিল জুমের মাধ্যমে। দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে যোগ দেয়া কঠিন ছিল। তাদের বিভিন্ন কৃষিসেবা সংস্থা বা কৃষি অধিদপ্তরে সমবেত করে ওই সংস্থার ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এটি দুটি বার্তা আমাদের দেয়, ডিজিটাইল ডিভাইড আছে। সাধারণ মানুষের কাছে প্রযুক্তির প্রাপ্যতা বা ব্যবহারে তাদের সক্ষমতা ঢাকা শহরকে দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, কৃষক কোনো সংস্থার সাহায্য নিয়ে যুক্ত হলে সেই সংস্থার ব্যাপারে খোলামেলাভাবে বলতে পারবেন না। তার পরও আমরা আলোচনায় যা দেখেছি, ৫ শতাংশ কৃষকও প্রণোদনার ঋণ পাননি। অন্যদিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক জানালেন, তাদের শাখা টার্গেট অনুযায়ী কৃষিঋণ বিতরণ করে ফেলেছে। প্রকৃত ও প্রান্তিক কৃষক যদি প্রণোদনা ঋণ না পান, তাহলে কে পেলেন? কাদের এই ঋণ দেয়া হলো? যেমন গদখালীর অধিকাংশ কৃষক, যারা ফুল বিক্রি করেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত। তারা প্রণোদনা ঋণ পাননি।  সুশীল সমাজের একটি সংস্থা জানাল, প্রান্তিক কৃষকরা প্রণোদনা ঋণ পাননি। কৃষকরা জানালেন, তারা তো পাননি, তাদের পরিচিত কারো কথাও উল্লেখ করতে পারলেন না। 

অধিকাংশ কৃষক জানালেন, তারা এমএফআই বা এনজিওগুলোর কাছ থেকেই ঋণ পান। সুদহার অনেক বেশি জানলেও তারা বাধ্য হয়েই এমএফআইয়ের কাছে যান। কারণ আর কেউ তাদের ঋণ দেন না।  সরকারি ব্যাংকে তারা অধিকাংশ সময় ইনভেস্টিগেশন অফিসার বা আইওর কাছে শুনতে পান যে ধরনের ঋণ তারা চাইছেন, সে ধরনের ঋণ তাদের শাখা থেকে দেয়া হয় না। অথবা যে কোটা ছিল, সেটা এরই মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়ে গেছে। কৃষক ঋণ পেলেন না, অথচ বরাদ্দ দেয়া শেষ! বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংক আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সত্ত্বেও পরে যোগ দেননি। সেটা নিয়ে আমাদের ক্ষোভ বা আফসোস নেই। তাদের ব্যস্ততা থাকতেই পারে। কিন্তু কৃষিঋণ তাদের প্রায়োরিটি লিস্টের কোথায় আছে, এটি সেই ইঙ্গিত দেয়। কিছুু বেসরকারি ব্যাংক জানিয়েছে, তারা প্রকৃত কৃষককে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু সেটির হার অনেক কম। বেশির ভাগই এমএফআইয়ের হাতে ঋণ তুলে দিয়ে তাদের টার্গেট পূরণ করেছে। আমি এটিকে খারাপ চোখে দেখি না। কারণ মহাসাগরে স্টিমার চলবে, নদীতে লঞ্চ আর খালে নৌকা। স্টিমার কখনো খালে চলতে পারবে না, যেমন নৌকা পারবে না সাগরে। স্টিমার থেকে কোনো পণ্য খালাস হয়ে লঞ্চে নদী পার হয়ে নৌকায় ছোট হাটে পৌঁছে—এটি চিরাচরিত পদ্ধতি। যার কাজ তাকেই করতে দিতে হবে। তাহলে গলদটা কোথায়?

প্রান্তিক কৃষকরা অধিকাংশ ভূমিহীন বা যেটুকু জমি আছে তা বাবার নামে। এখনো ভাইবোনদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়নি। তাই জমির দলিল তাদের নামে নেই। আর জমি ছাড়া ব্যাংক ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ভূমিহীন এসব দিনমজুর বা দিনে এনে দিনে খাওয়া লোকদের ঋণ দিলেও তারা আদায় করে, সেটি আজ প্রমাণিত। তবে কঠিন পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে। সেটিই করছে এমএফআই। প্রতি সপ্তাহে তাদের বাড়িতে ভিজিট করছে। কিস্তিতে টাকা আদায় করে নিয়ে আসছে। কারণ একসঙ্গে কৃষকের পক্ষে এত টাকা (৪০ বা ৫০ হাজার) দেয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকের পক্ষে এভাবে প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি দুই সপ্তাহে মনিটরিং করা সম্ভব নয়। নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে এমএফআইয়ের ওভারহেড খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যেমন বেশি কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। তাদের যাতায়াত ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিতে হচ্ছে। এমএফআই একসময় ১৫ শতাংশ ফ্ল্যাট রেটে ঋণ দিত। ফ্ল্যাট রেট মানে হলো, আপনি যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, সেটার ওপরেই সুদ ধার্য করা হবে। প্রতি সপ্তাহে যে শোধ দিচ্ছেন, ঋণীর হাতে এনজিওর টাকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে (রিডিউসিং ব্যালান্স), সেটা বিবেচনায় নেয়া হতো না। ব্যাংক সুদ নেয় রিডিউসিং ব্যালান্সের ওপর।  ফ্ল্যাট রেট রিডিউসিং ব্যালান্সের প্রায় দ্বিগুণ হয়। অবশ্য এটি নির্ভর করে কতদিন পরপর আদায় হচ্ছে এবং বকেয়া পড়েছে কিনা তার ওপর। 

অধিকাংশ এমএফআই জানাল, তারা এমআরএর নিয়মের মধ্যেই সুদ আদায় করছে। এমআরএ ধার্যকৃত সর্বোচ্চ সুদের হার ক্রমহ্রাসমান স্থিতির ওপর ২৪ শতাংশ। এমএফআইয়ের কাছে যখন জানতে চাইলাম, এটি তো সর্বোচ্চ হার। এর নিচে আদায় করতে তো মানা নেই। তাহলে করছে না কেন? তারা উচ্চসুদে ব্যাংক থেকে ঋণ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ ব্যয় ও কুঋণের কথা জানাল। কুঋণ আর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ব্যয় বিপ্রতীপ। অর্থাৎ একটি বাড়লে অন্যটি কমে। তাছাড়া ঋণের পোর্টফোলিও যত বাড়বে, গড়  পর্যবেক্ষণ ব্যয় তত কমে আসবে। অর্থাৎ একজন মাঠকর্মীর প্রথম বছর বেতন ২০ হাজার টাকা হলে তিনি যদি ৫০ লাখ টাকার পোর্টফোলিও দেখেন, দ্বিতীয় বছর তার বেতন ১০ শতাংশ বেড়ে ২২ হাজার টাকা হলেও তিনি হয়তো ৭০ লাখ টাকার পোর্টফোলিও নজরদারি করবেন। কর্মী ব্যয় প্রথম বছর ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।  অর্থাৎ ১০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির পরও ঋণপ্রতি গড় ব্যয় কমে গেছে। 

কস্ট অব ফান্ড কমানোর জন্য ঋণীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকসহ বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ শতাংশ সুদে সঞ্চয় নেয়া হয়। কোনো কোনো এমএফআইয়ের সঞ্চয়ের পরিমাণ মোট ঋণের ৪০ শতাংশের (ব্যুরো বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ সালে ৫১%, ব্র্যাক ২০১৮-১৯ সালে ৩৯.৭%) ওপর। ২০১৮-১৯ সালে ব্র্যাকের সঞ্চয় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেড়েছে। এমআরএর নিয়ম অনুসারে, একটি এমএফআই সর্বোচ্চ মোট ঋণের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সঞ্চয় নিতে পারবে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হারটি উল্টো। সেখানে অ্যাসেট ডিপোজিট বা এডি রেশিও হিসাব ধার্য করা হয়, যা বর্তমানে ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা সঞ্চয় থাকলে ৮৭ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে।  

এমএফআই কার্যত ৭-৮ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ করে ২৪ শতাংশ বিতরণ করছে। সঞ্চয় ও ঋণের সুদহারের এই পার্থক্যকে বলে স্প্রেড। ব্যাংকের ক্ষেত্রে স্প্রেড সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হতে পারবে। এমএফআইয়ের ক্ষেত্রে স্প্রেডের ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ নেই। বর্তমানে সেটি ১৬-১৭ শতাংশ। উচ্চ পর্যবেক্ষণ ব্যয় ও উচ্চ কুঋণ (প্রকৃত বিচারে এমএফআইয়ের কুঋণ ব্যাংকের চেয়ে কম) এজন্য বাড়তি ৫-৬ শতাংশ ধরলেও এমএফআইয়ের স্প্রেড ১০-১১ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেক্ষেত্রে ভোক্তা অর্থাৎ দরিদ্র কৃষক বা স্বল্প আয়ের উদ্যোক্তাদের ১৭-১৯ শতাংশ ক্রমহ্রাসমান বার্ষিক সুদহারে ঋণ পাওয়া উচিত। অনেক এমএফআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তারা ১০-১২ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করেন। জাইকার অর্থায়নে এসএএমপি নামে একটি প্রজেক্টে এই সুদহার নির্ধারণ করা আছে। অনেক এমএফআই আবার বলল, সর্বক্ষেত্রে তারা ১২ শতাংশ সুদ নেয়। হিসাব করে দেখা গেল, সেটি ফ্ল্যাট রেট। অর্থাৎ এখনো তারা কৃষককে প্রকৃত তথ্য দিচ্ছে না। যদিও কৃষকের হাতে অন্য কোনো অপশন নেই। যেটি আছে সেটি মহাজন—১০০ টাকায় মাসে ১০ টাকা, অর্থাৎ বছরে ১২০ টাকা সুদ দেয়া।

অর্থ কৃষকের হাতে পৌঁছানোর জন্য এমএফআইয়ের ওপরই নির্ভর করতে হবে। সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতি তাদের দালালের হাতে কৃষককে বন্দি করে রাখছে। এ বলয় কে ভাঙবে? বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কৃষিঋণ অলাভজনক করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন, কীভাবে এই ঋণ আরো সস্তা করা যায়। সেক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব: এমএফআইকে সঞ্চয় সংগ্রহের জন্য আরো বিস্তৃত সুযোগ দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে ঋণ ও সঞ্চয়ের গ্রাহক আলাদা। যাদের হাতে বাড়তি টাকা আছে তারাই সঞ্চয় করবে, সেটি প্রবাসীর স্ত্রী বা পরিবার, ছোট সফল ব্যবসায়ী বা জেলা শহরের ছোট চাকরিজীবী হতে পারেন। ব্যাংক তাদের কাছ থেকে মাসে ১০০ টাকা সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে না। কিন্তু এমএফআই সেই সঞ্চয় সংগ্রহ করতে পারে। এমএফআইয়ের গ্রাহকসংখ্যার ৭০ শতাংশ ঋণী হতে হবে। অথচ ব্যাংকের ক্ষেত্রে দৃশ্যটি উল্টো। এছাড়া এমএফআইয়ের ইকুইটির ২৫ শতাংশ মেয়াদি এবং আরো ২৫ শতাংশ স্বেচ্ছা সঞ্চয় নেয়ার বিধান। কুঋণের হার গত ১০ বছরে ৯৫ শতাংশ এবং চলতি বছর ৯০ শতাংশের কম হতে হবে। এমএফআইটি কমপক্ষে গত তিন বছর লাভজনক হতে হবে। এই বিধানগুলো সংশোধন করতে হবে। ব্যাংকের মতো ইকুইটি এডিকোয়েসি রেশিও প্রয়োগ করা যায় কিনা দেখতে হবে। ঋণীর কত শতাংশ পর্যন্ত সঞ্চয়ী হতে পারবে, সেই বিধান তুলে দিতে হবে। সঞ্চয় স্বয়ং একটি সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যা অপ্রতুল বলেই লোকজন ইউনিপে বা ডেসটিনিতে টাকা রাখে। এমএফআই এই ক্ষুদ্র সঞ্চয় মোবিলাইজ করতে পারত। যেটা তারা আবার গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঘূর্ণায়মান রাখত, এজেন্ট ব্যাংকের মতো চিপে-চুষে নিয়ে এসে শহরে বিতরণ করত না। 

সাংবাদিকরাও ওই বৈঠকে ছিলেন। কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, তারাও স্বীকার করলেন। কিন্তু সে সংবাদ তারা যখন লেখেন, পত্রিকায় গুরুত্ব পায় না। বিজিএমই, বিকেএমইএ, ডিসিসিআই কোনো দাবি তুললে সেটি নিয়ে তোলপাড় পড়ে যায়। কৃষকের কথা বলার জন্য কেউ নেই। এই মূঢ় মূক কৃষকের কান্না তাই গুমরেই মরে। নীরবে। নিভৃতে। 


শওকত হোসেন: পরিচালক, লাইট ক্যাসল পার্টনার্স

ফেলো অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন