তত্ত্বতালাশ

আধুনিক অর্থসংক্রান্ত তত্ত্বের মিথ প্রসঙ্গে

অতমার ইসিং

অনেক লোক দাবি করছে যে কভিড-১৯ মহামারী প্রমাণ করেছে আধুনিক অর্থসংক্রান্ত তত্ত্বই সরকারগুলোর (এমএমটি) এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। ধারণা বা অভিজ্ঞতা না থাকাদের জন্য এমএমটি অবশ্যই অতিমাত্রায় সূক্ষ্ম, জটিল, এমনকি বিজ্ঞানসম্মত মনে হতে পারে। এর প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোপারনিকীয় বিপ্লবের তুলনাযোগ্য একটি নতুন অর্থনৈতিক প্যারাডাইমের উন্নয়ন তারা ঘটিয়েছেন, যদিও চকচকে শিরোনাম ও নীতি ঘোষণার বাইরে একটি বার্তা লুকিয়ে আছে যে এটি যেমন সহজ তেমনি বিপজ্জনকও। বিশেষ করে এখন বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো যেহেতু মহামারীকালে অর্থনীতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে মুক্তভাবে ব্যয় করছে। 

এমএমপি অনুযায়ী, সরকারগুলো পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত যত ইচ্ছা ব্যয় করতে পারে এবং সেটি অর্থায়ন সম্পর্কে কোনো ধরনের উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ছাড়াই। কেননা কোনো খরচ ছাড়া নিছকই প্রিন্টিং প্রেস পরিচালনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ জোগাতে পারবে। কেন্দ্রীয় ধারণার মৌলিকত্বহীনতা ও গতানুগতিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে অর্থনৈতিক চিন্তায় এই অবদানকে আদৌ কোনো নতুন ‘তত্ত্ব’ বলা যায় কিনা, এটি ব্যাপকভাবে বিতর্কযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে, সরকারি ব্যয় সম্পর্কে ধারণাগুলো আমাদের ১৯৪০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ আবা পি. লার্নারের ‘ফাংশনাল ফিন্যান্স’ ধারণার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এমএমটি নিছকই সরকার কর্তৃক চাকরি নিশ্চয়তায় (ফেডারেল জব গ্যারান্টি) পর্যবসিত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ র্যানডাল রের মডার্ন মনিটারি থিওরি: অ্যা প্রাইমার অন ইকোনমিকস ফর সভরেন মনিটারি সিস্টেমসের মতো প্রথম প্রকাশনাগুলো কয়েক বছর আগে সামনে আসে এবং বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে প্রায় সবারই সমালোচনার মুখোমুখি হয় এটি। তবুও এখনো এমএমটি-বিষয়ক বিতর্ক চলমান, কারণ যুক্তরাজ্যের সাবেক লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন এবং মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স প্রাথমিকভাবে এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণায় তুলে ধরেছিলেন।

২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২০ সালে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির সময়ে স্যান্ডারসের উপদেষ্টা ছিলেন স্টাফানি কেলটন। তিনি এমএমটির অন্যতম সুপরিচিত প্রবক্তা এবং দ্য ডেফিসিট মিথ: মডার্ন মনিটারি থিওরি অ্যান্ড দ্য বার্থ অব দ্য পিপলস ইকোনমি নামে নতুন একটি বইয়ের লেখক। স্যান্ডারস সাম্প্রতিক বেশির ভাগ প্রচারাভিযানে এমএমটিকে তার অর্থনৈতিক নীতি কর্মসূচির কেন্দ্রে রেখেছেন। জো বাইডেন তত্ত্বটির কেন্দ্রীয় ধারণা গ্রহণ করবেন কিনা, সেটি দেখাটা এখন বাকি রয়ে গেছে।

যেকোনো ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে বামপন্থীরা এমএমটি দ্বারা বেশ উত্তেজিত থাকবেন, কারণ তারা মনে করেন যে কর্মসংস্থান চাঙ্গা, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায্যতার অগ্রগতি এবং আরো অনেক কিছুসহ সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য এটি প্রধান চাবিকাঠি। ফেডারেল জব গ্যারান্টির প্রস্তাব পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং ‘ভালো চাকরির’ প্রতিশ্রুতি দেয়, যা সুফলদায়ী সরকারি উদ্দেশ্য পরিপূরণে সম্পাদিত কাজের জন্য একটি জীবনধারণ উপযোগী মজুরি প্রদান করে।

তবে যে কেউ বিস্মিত হতে পারেন যদি এমএমটির অনুগামীরা তখনো এর পক্ষে বলেন এবং যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কারো দ্বারা এটি আদৃত হয়, যিনি কিনা মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। বিনা খরচে অনির্দিষ্ট পরিমাণ সরকারি ব্যয়ের অর্থায়ন যদি করা যায় তাহলে যে ক্ষমতায় থাকবে, সে-ই দুধ-মধুর স্বর্গে বাস করবে। কিন্তু সেটি হবে ক্ষণস্থায়ী স্বর্গ, কারণ সরকারি ব্যয়ের উন্মত্ততা অপরিহার্যভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি ঘটাবে, যখন সুযোগের জানালা বন্ধ হবে এবং বেকারত্ব ও দুর্বল প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মাধ্যমে নাগরিকরা বিল পরিশোধে অসমর্থ হবে।

এ সমস্যা স্বীকার করে এমএমটি প্রস্তাব করে যে সরকারগুলো কর বাড়াবে এবং যখন প্রয়োজন হবে মূল্যস্ফীতি এড়াতে প্রচুর অর্থ সার্কুলেশন থেকে সরাবে। একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক: সরকারি ব্যয়ে যেখানে কোনো আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ছিল না, সেখানে হঠাৎ করে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো এবং কর অবশ্যই বাড়াতে হবে সার্কুলেশনে থাকা অর্থের ধাক্কা সামলাতে! এমএমটি দ্বারা প্রয়োগকৃত ধারণার চেয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারণার সম্মুখীন হওয়া অধিক সহজ। 

এমনকি যদি রাজনীতি কাজ করেও তাহলেও গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চকরের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির কী হারে অর্থ সংগ্রহ করা হবে? পাইপলাইনে থাকা এরই মধ্যে অনুমোদিত সরকারি প্রজেক্টগুলোর কী হবে? কীভাবে নীতিনির্ধারকরা মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন হিসাব করবেন, যা এরই মধ্যে হয়েতো মজুরি, সুদহার এবং অসংখ্য চুক্তিতে আরোপিত হয়ে গেছে? অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একবার শুরু হয়ে গেলে মূল্যস্ফীতিমূলক প্রক্রিয়া বেকারত্ব বৃদ্ধিসহ উল্লেখযোগ্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যয়ে বিপুল অভিঘাতের বিনিময়েই থামানো সম্ভব। পশ্চিমা বিশ্ব ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকেই স্পষ্টভাবে এ ধরনের অগ্নিপরীক্ষা সহ্য করেছিল।   

সত্যি বলতে কি, এমএমটির প্রবক্তারা কারিগরিভাবে সঠিক, যখন তারা উল্লেখ করেন যে নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ পরিশোধে সমর্থ যেকোনো দেশ দেউলিয়া হবে না। কারণ এটি ঠিক কী পরিমাণ অর্থ সৃষ্টি করতে পারবে তার কোনো পরিসীমা নেই। তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওই মুদ্রায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে ইচ্ছুক হবেন, সেটি আশা করা যায়। ব্যক্তি খাতের  উদ্যোগগুলোর জন্য বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী মূলধন প্রবেশ কার্যকরভাবে বন্ধ হতে পারে। আবারো এ সমস্যার জন্য এমএমটির একটা দায় থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তারা (এমএমটির প্রবক্তরা) অজুহাত দেয় যে সরকার তার সুদহারে নিয়ন্ত্রণ হারাবে না।

যেমনটা অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, যে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যত বেশি, সে দেশের মূল্যস্ফীতির হার তত কম। এ কারণে সব শীর্ষ অর্থনীতি (প্রধানত ১৯৯০-এর দশকে) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিষয়টিতে প্রথমেই জোর দিয়েছিলেন। এমএমটি অবশ্য প্রিন্টিং প্রেসের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্ব নাকচ করবে এবং সরকারের হাতে সেই ক্ষমতা প্রদান করবে। ইতিহাস যেমনটা দেখায় যে জরুরি মুহূর্তে স্বাভাবিক নিয়মগুলো রহিত হয়। এমএমটি এমন এক অ্যাপ্রোচ, যা এ ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করবে।  

প্রায় শূন্য বা ঋণাত্মক সুদহার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সরকারি সিকিউরিটিজের ব্যাপকতর ক্রয়ের আজকের পরিবেশে এমএমটির দিকে যাওয়ার একটি পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করছি। সুদহার বৃদ্ধি থামাতে সরকারগুলো যদি বিপুল পরিমাণ সরকারি সিকিউরিটিজ কিনতে নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করে, তাহলে মনে করতে হবে এরই মধ্যে তারা কার্যকরভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মুদ্রা-অর্থ সৃষ্টির বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিয়েছে।

সরকারি সিকিউরিটিজ কেনা হ্রাস বা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে নীতিগতভাবে একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেকোনো মুহূর্তে এই প্রক্রিয়া শেষ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাত্পর্যজনক রাজনৈতিক চাপ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এমএমটি প্রবক্তাদের আকাঙ্ক্ষিত অবস্থানে কার্যত নিঃশেষিত হয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সংস্থাটির সামর্থ্য ও সক্ষমতা এক বিরাট প্রশ্নে পরিণত হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]


অতমার ইসিং: ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পর্ষদ সদস্য 

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন