উন্নয়ন ভাবনা-৬

অর্থনৈতিক উন্নয়ন: জনমিতিক মুনাফা এবং বাংলাদেশ

মোহা: কাওসার আলী

প্রবাদে আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের এক ফোড় অসময়ের দশ। আবার সুযোগ নাকি বারবার আসে না। এগুলো ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কথাগুলো অনেক বেশি প্রযোজ্য বলে মনে হয়। 

বিশেষজ্ঞদের মতে দীর্ঘ ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ১৯৮০ সাল থেকে উন্নয়ন ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়  অতিক্রম করছে। যা শেষ হবে ২০৩৫ বা ২০৪০ সালে। পৃথিবীতে যেসব দেশ এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে তাদেরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ের উজ্জ্বল উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। দুনিয়ার সবাই এখন দক্ষিণ কোরিয়াকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবেই জানে। যারা সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি তাদের কথা না হয় না-ই বললাম।

সুযোগটিকে জনমিতিক মুনাফা (Demographic Dividend) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটা জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। UNFPA এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী যখন কোন দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (বয়স ১৫-৬৪) তার নির্ভরশীল জনসংখ্যার (১৪ বা তার নিচে এবং ৬৫ বা তার বেশি) চেয়ে বেশি থাকে তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর যে সু্যোগ তৈরি হয় সেটাই জনমিতিক মুনাফা। অন্য কথায় যখন জনসংখ্যার নির্ভরশীল অংশের তুলনায় কর্মক্ষম অংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা/প্রবৃদ্ধি উচ্চতর (boost) পর্যায়ে পৌঁছায় জনসংখ্যার এই অবস্থাই জনমিতিক মুনাফা। জনসংখ্যায় বয়স-কাঠামোর এই সুযোগের বিস্তৃতিকাল সাধারণভাবে ৫০-৬০ বছর। 

উল্লেখ্য যে, অর্থনীতিবিদ Thomas Malthus এর সময় অর্থাৎ ১৭৯৮ সালে তাঁর Essay on “The Principle of Population” প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই  জনসংখ্যার পরিবর্তনের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি র সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা চলমান। শুরুতে জনমিতিক মুনাফা (demographic dividend) জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে যুক্ত থাকলেও সাম্প্রতিক কালে ১৯৮০ থেকে জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর (age structure) পরিবর্তন এর সাথে এবং পরবর্তীতে ২০০০ সাল থেকে বয়স কাঠামোর সাথে শিক্ষাকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

একটি দেশে জনমিতিক মুনাফাকালে কী ধরণের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তা একটু দেখে নেয়া যেতে পারে: 

১. জন্মহার হ্রাস পায়

২. মহিলাপ্রতি সন্তানসংখ্যা (TFR) কমে যায়

৩. নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি থাকে

৪. মহিলাদের জন্য কর্মসুযোগ তৈরি হয়। তারা আয়বর্ধক কর্মে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করে

৫. পরিবারের আয় বেড়ে যায় এবং সন্তান সংখ্যা কমে যাওয়ায় ব্যয় হ্রাস পায়

৬. ছোট ও একক পরিবার সংখ্যা বাড়তে থাকে

৭. মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেতে থাকে

৮. সঞ্চয়-বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়

এখানে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে  বয়স কাঠামোর পরিবর্তজনিত কারণে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধি পেলেই একটি দেশ জনমিতিক মুনাফা অর্জন করে ফেলবে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়।  অর্থনীতিবিদদের মতে কোন দেশে জনমিতিক মুনাফা এর সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক উন্নয়ন/প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আবশ্যিকভাবে কয়েকটি কাজ করতে হয়। যেমন:  

১. আয়বর্ধক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন 

২. জাতীয় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক জনসংখ্যা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং 

৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা অর্থাৎ মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগ। 

বিপরীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনমিতিক মুনাফা এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অর্থনীতিকে একটা শক্ত অবস্থানে না নেয়া গেলে মেয়াদ শেষে এক পর্যায়ে নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাত বেড়ে যায়। তখন যে চাপ তৈরি হবে তা সামাল দেয়া যে কোন দেশ বিশেষ করে তুলনামূলক দূর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদরা এই আশংকার কথাও গুরুত্বসহকারে বলে থাকেন।

PNAS(Proceedings of the National Academy of Science of the USA গবেষক Wolfgang Lutz ও তার দল একটি গবেষণার কথা এখানে উল্লেখ করা যথার্থ হবে বলে মনে হয়। ১৯৭০-২০১৫ সময়ে বিশ্বের ১৬৫ টি দেশের উপর  গবেষণাটি করা হয়। কেস স্টাডি হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া এবং নাইজেরিয়াকে বিবেচনায় নেয়া হয়। গবেষণায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পরিবর্তিত বয়স কাঠামো এবং ক্রমবর্ধমান মানবসম্পদ এর তুলনামূলক গুরুত্ব পর্যালোচনা করে দেখা হয়। সেখানে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় বয়স কাঠামোর চেয়েও শিক্ষার ভূমিকা প্রধান এবং মানবসম্পদ দ্বারাই মূলত জনমিতিক মুনাফা নির্ধারিত (driven) হয়ে থাকে(উদাহরণ- দক্ষিণ কোরিয়া)। তারা দেখতে পান দক্ষিণ কোরিয়া বয়স কাঠামোর (age structure) সাথে যথোপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দ্বারা দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের মাধ্যমে যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে সেখানে যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা না করা বা দূর্বল হলে তাদের প্রবৃদ্ধি এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যেত। অন্যদিকে ক্রমহ্রাসমান নবীন জনসংখ্যার (Declining youth dependency ratios এর) সাথে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে তা বরং প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত ( negative impacts) করে(উদাহরণ- নাইজেরিয়া)। 

এখন প্রশ্ন হতে পারে জনমিতিক মুনাফা এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোন পর্যায়ে।

দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনমিতিক মুনাফাকাল শুরু হয়েছে ১৯৮০ সালে এবং তা সর্বোচ্চ ৬০ বছর মেয়াদে চলমান থাকবে অর্থাৎ ২০৪০ সালে শেষ হবে। এবার চলুন দেখে নিই বাংলাদেশে জনসংখ্যার সাম্প্রতিক চিত্রটি কেমন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বয়স কাঠামো অনুযায়ী  জনসংখ্যার অনুপাত ছিল:

০০ – ১৪ বছর: ২৭.৭৬%

১৫ – ৬৪ বছর: ৬৬.০২%

৬৫ এবং তদূর্ধ্ব: ৬.২৩%

অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬% ছিল কর্মক্ষম। বাকী ৩৪% ছিল নির্ভরশীল অংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত আমাদের জনমিতিক চিত্রটি দেখুন:          

 

চিত্রে ২০১০, ২০১৯ ও ২০৪০ সালের অবস্থ দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে জনসংখ্যার নির্ভরশীল অংশের  তুলনায় কর্মক্ষম অংশ সবচেয়ে বেশি ২০১৯ সালে। এরপর তা ক্রমাগত কমতে থাকবে এবং ২০৪০ সালে ১৫-৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের অনুপাত মোট জনসংখ্যার ৫০% এর নীচে নেমে যাবে।

দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরপরই অর্থাৎ ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ জনমিতিক মুনাফা পর্বে প্রবেশ করেছে। এবং ইতোমধ্যে ৪০ বছর বা দুই-তৃতীয়াংশ সময়কাল পার করে ফেলেছে। আমাদের অর্জন নেই একথা বলা ঠিক হবে না। যেমন- মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদনসহ শিক্ষার হার, গড় আয়ু, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে  বাংলাদেশের অগ্রগতি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকের প্রশংসা পেয়েছে। 

কিন্তু ১৯৬০ এর দশকে প্রায় একই রকম অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করা এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় সাথে তুলনা করলে বেশ কিছুটা অস্বস্তি জাগতেই পারে বৈ কি। কারন ঐ দেশগুলো জনমিতিক ডিভিডেন্ড এর সুযোগ আক্ষরিক অর্থেই কাজে লাগাতে পেরেছে। ফলে আমরা যেখানে ৪০ বছরে মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলারে উন্নীত করতে পেরেছি দক্ষিণ কোরিয়া ও সিংগাপুর একই সময়কালে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়া অবশ্য এখনো উন্নত দেশের তালিকায় যেতে পারেনি। তবে একেবারে দ্বারপ্রান্তে।

জনমিতিক মুনাফা বিষয়ে বাংলাদেশে আলাদাভাবে কোন গবেষণা হয়েছে কি না জানা সম্ভব হয়নি। তবে হলে তা সত্যিই চমৎকার হতো। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি ১০/১৫ বা ‌২০ বছর অন্তর গবেষণা পরিচালনা এবং উহার সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হলে তা অনেক ফলপ্রসূ হতে পারতো।  যা-ই হোক না কেন এই মুহূর্তে আলোচ্য বিষয়ের উপর গবেষণা হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কারন এতে করে ১৯৮০-২০২০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরের অর্জন, ঘাটতি এবং আগামী সময়টুকু (২০ বছর) কীভাবে বেশি করে কাজে লাগানো যায় তা জানা সম্ভব হবে। ফলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও জনমিতিক মুনাফা এর সুফল বেশি বেশি ঘরে তোলা সহজ হতো। এই প্রত্যাশাটুকু কি আমরা করতে পারি না?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব
e-mail: [email protected]


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন