ওয়েবিনারে বক্তারা

‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রয়োজন বৈশ্বিক উদ্যোগ’

নাগরিক সংবাদ

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে গত ৪ বছর ধরে বাংলাদেশের বসবাস। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশ বেশ সফল হলেও তাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ)-এর বছরব্যাপী রোহিঙ্গা অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম। এই উদ্যোগের আওতায় গত ১৪ নভেম্বর, ২০২০ তারিখ শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সিরিজের প্রথম ওয়েবিনার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত এই ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমনস-এর এবেরাভনের সংসদ সদস্য এবং এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলবিষয়ক লেবার পার্টি সমর্থিত মন্ত্রী স্টিফেন কিনক, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমেদ মুশফিক মোবারক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহযোগী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টিভেন করলিস। প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী চলমান এই ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন ওয়াইপিএফের কনটেন্ট ও সম্পাদকীয় শাখার প্রধান মাসতুরা তাসনিম।

‘দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: শেয়ার্ড গ্লোবাল রেসপন্সিবিলিটি’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারের শুরুতে ওয়াইপিএফ-এর নির্বাহী পরিচালক জনাব আমের মোশতাক আহমেদ তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয়াদির উপর রোহিঙ্গা সংকটের বিরূপ প্রভাবসমূহ উল্লেখ করে বলেন, ‘বৈশ্বিক সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের সঠিক কাজটি করতে বাধ্য করার এখনই সময়। কোন দেশেরই এমন সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা উচিত নয়। কোনো দেশকেই একা একা এমন সংকটের সম্মুখীন হতে না হলে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের জন্য আমরা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারবো। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কাছেও এই আশার বার্তা পাঠাতে পারবো যে গোটা বিশ্ব তাদেরকে এই দুর্যোগের মধ্যে ত্যাগ করেনি, করবেও না।’

আলোচনার প্রথমেই ড. আহমেদ মুশফিক মোবারক রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে করা তার গবেষণার চুম্বকাংশ তুলে ধরেন। এ সময় ড. মোবারক রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন সহিংসতার পিছনে অর্থনৈতিক কারণ আছে বলে উল্লেখ করেন। তার গবেষণায় দেখা যায় যেহেতু মিয়ানমারের প্রধান খাদ্য ভাত, তাই কোথাও যদি চালের দাম বাড়ে, সেই স্থানে জনসাধারণের উপর অত্যাচার, সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন এবং লুটতরাজের হার বেড়ে যায়। এছাড়াও রোহিঙ্গা মিলিশিয়াদের যেকোনো সশস্ত্র কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়ার যে তীব্রতা ও স্থায়িত্ব পরিলক্ষিত হয়, অন্য কোনো নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। ড. মোবারক বলেন, এ কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সাথে যে সংঘাত তা বাদ-বাকি অন্য সকল নৃগোষ্ঠীর থেকে অনেক বেশি ভিন্ন। কক্সবাজারে বসবাসরত ৫ হাজার উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে চালানো তার এক জরিপে সহিংসতার অভিজ্ঞতার কারণে রোহিঙ্গাদের ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার দিকটি উঠে আসে। পাশাপাশি কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও মানসিক বিষাদের বর্ধিত হার দেখা গেছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক মহল তাদের দায়িত্ব পালন করেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ‘আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে অপর্যাপ্ত’ উল্লেখ করে স্টিফেন কিনক বলেন, এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের উচিত গাম্বিয়াকে স্যালুট করার পাশাপাশি যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত গাম্বিয়ার কেসকে সমর্থন করার জন্য একে পূর্ণ আইনি সহায়তা প্রদান করা।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যাটিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করে তাদেরকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সেফ প্যাসেজ করিডোর এবং পরবর্তীতে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে বাধ্য করতে হবে; পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যক্রমেও আরো স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। মিয়ানমারের নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কমিশনে যুক্তরাজ্যের অর্থায়নের বিষয়টির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে তিনি বলেন, বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার প্রসঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়ে যদি সেজন্য লাগাতার রোহিঙ্গাদের অধিকারকে জলাঞ্জলি দিতে হয়।

আলোচনার এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদের কাছে আশ্রয়প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কী কী বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি মূলত দুটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেন- নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফেরার ব্যাপারে আস্থাহীনতা এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহাকরে দেখতে হবে এবং মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে এই সংকট সমাধানের আগে অন্য কোনো বিষয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার আমাদের দোষারোপ করে যে আমরা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পারছি না, আদতে তারাই প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারছে না। এছাড়াও বাংলাদেশের মিত্র দেশগুলো থেকেও এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশের মত সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

আলোচনায় বক্তব্যের শুরুতে স্টিভেন করলিস এদেশের যেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষরা উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের সাধুবাদ জানান। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর এর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সহকর্মীরা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে প্রত্যাবাসন প্রতিরোধ, আস্থাহীনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচলিত একটি ভুল ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি প্রায়ই শুনি যে ‘রোহিঙ্গাদেরকে বেশি আরামে রাখা যাবে না’। আসলে তারা খুব একটা আরামে নেই-ও, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেলেই এই বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যায়। 

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান এবং তাদের এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ এগিয়ে আসায় তিনি বাংলাদেশকে ‘হিউম্যানিটয়ারিয়ান সুপার পাওয়ার’ আখ্যা দিয়ে বলেন যে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সচেতনতা তৈরি কিংবা অ্যাডভোকেসি করার জন্য রোহিঙ্গাদের সাথে একাত্মতা বোধ করা, তাদের প্রতি সহমর্মী দৃষ্টিভঙ্গী লালন করা আবশ্যক।

বক্তারা মিয়ানমারের উপর বহির্বিশ্বের চাপ প্রয়োগ এবং সংকট উত্তরণে সমন্বিত বৈশ্বিক উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

• সুবাহ বিনতে আহসান
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন