করোনায় ক্ষতির মুখে অধিকাংশ বড় স্পিনার

বদরুল আলম

দেশের অন্যতম শীর্ষ সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। দুই প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে স্পিন্ডল যন্ত্র (সুতা কাটার টাকু) রয়েছে তিন লাখেরও বেশি, শ্রমিক কাজ করেন ২৮ হাজার। প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে বাদশা টেক্সটাইল গত বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সুতা রফতানি করেছিল পৌনে ১০ কোটি ডলারের। অন্যদিকে চলতি বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি সুতা রফতানি করেছে প্রায় কোটি ৫৯ লাখ ডলারের। হিসেবে করোনার নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির রফতানি কমেছে ২২ শতাংশ। একই সময়ে কামাল ইয়ার্নের সুতা রফতানিও কমেছে ২৯ শতাংশ।

শুধু বাদশা টেক্সটাইল বা কামাল ইয়ার্ন নয়, দেশের ছোট-মাঝারি-বড় সব আকারের সুতা কারখানাই করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে ব্যবসার আকার এবং বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশ বিবেচনায় তুলনামূলক বড় কারখানাগুলোই বিপদে পড়েছে বেশি। বর্তমানে দু-একটি শীর্ষস্থানীয় স্পিনিং মিল ছাড়া বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে স্পিনারদের অধিকাংশই। ক্রয়াদেশ সংকট কাটিয়ে এসব কারখানায় বর্তমানে পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার হলেও করোনাজনিত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসব প্রতিষ্ঠানের এখনো সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কভিড-১৯ মহামারীতে চলতি বছরের শুরুর দিকেই স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। পশ্চিমা দেশগুলোর খুচরা বাজারের স্থবিরতায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পোশাক পণ্যের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করে ক্রেতারা। বস্ত্র শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিকতায় বিপাকে পড়ে পোশাক পণ্যের সুতা-কাপড় সরবরাহকারী দেশের পশ্চাত্সংযোগ বা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, শিল্পের শীর্ষস্থানীয় সুতা উৎপাদনকারী স্পিনাররা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এখন উৎপাদন সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার শুরু হলেও দ্রুতই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারছেন না তারা।

বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, স্পিনিং শিল্পের বড়-ছোট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্দিন কাটাতে পারেনি। কোনো রকমে কারখানা সচল রেখেছে মাত্র।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে পরিচিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতে সুতা কাপড়ের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আছে হাজার ২৩২টি। এছাড়া কাপড় প্রক্রিয়াজাত করার ডায়িং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল আছে আরো ২৪৪টি। হাজার ৪৮৮টি মিলের মধ্যে স্পিনিং মিল আছে ৪৩৩টি, যার মধ্যে রফতানিমুখী দুই শতাধিক। এসব মিল দেশের রফতানিমুখী নিট পোশাক কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় সুতার ৮৫-৯০ শতাংশ সরবরাহ করে। এছাড়া রফতানিমুখী ওভেন পোশাক পণ্যের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে প্রতিষ্ঠানগুলো। শিল্পে মোট বিনিয়োগ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিটিএমএর হিসাবে, ২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে দেশের শীর্ষ দশ সুতা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল যথাক্রমে বাদশা টেক্সটাইস, কামাল ইয়ার্ন, স্কয়ার টেক্সটাইলস, পাকিজা কটন স্পিনিং মিলস, ভিয়েলাটেক্স স্পিনিং, এমএসএ স্পিনিং, ম্যাকসন্স স্পিনিং, এনআরজি স্পিনিং মিলস এমএসএ টেক্সটাইলস।

দেশের অন্যতম শীর্ষ সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাদশা টেক্সটাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদশা মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, গত ছয়-সাত মাসে আমরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। মার্চ-এপ্রিলে তুলার দাম স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় পাউন্ডপ্রতি ১৫ সেন্ট পড়ে গিয়েছিল, যার প্রভাবে সুতার দাম কেজিতে কমেছে ৩৫ সেন্ট। অবস্থায় খাতের সবাই লস করেছে। পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় আমরা পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। পরে পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করে। ধারাবাহিকতায় অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসে। কিন্তু দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

কারখানা বন্ধ থাকায় হতাশ পোশাক শিল্প মালিকরা ১০ টাকার পণ্য টাকায় বিক্রি করছেন এমন তথ্য উল্লেখ করে বাদশা মিয়া বলেন, স্পিনিং মিল মালিকরা লাভ না করলেও যেহেতু বেশি দামে তুলা কেনা হয়েছিল, পরে দাম কমলেও আমরা কম দামে ক্রয় করিনি। তুলার দাম এখন আবার বেড়েছে। এখন স্পিনিং মিলগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে শুরু করেছে। তীব্র প্রতিযোগিতায় আমরা সরাসরি সুতা রফতানিও করতে পারছি না।

বছরের প্রথম নয় মাসে রফতানিতে ইতিবাচক অবস্থানে ছিল এদিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা স্কয়ার টেক্সটাইলস। সময় প্রতিষ্ঠানটির রফতানি বেড়েছে দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর চতুর্থ অবস্থানে থাকা পাকিজা কটন স্পিনিং মিলসের রফতানি চলতি বছরের নয় মাসে কমেছে ৩৪ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে থাকা ভিয়েলাটেক্স স্পিনিং লিমিটেডের সুতা রফতানি কমেছে সবচেয়ে বেশি, ৪৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা এমএসএ স্পিনিং লিমিটেডের রফতানি চলতি বছরের একই সময়ে কমেছে দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত বছর সপ্তম অবস্থানে থাকা ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলসের রফতানি চলতি বছর কমেছে ২২ শতাংশ। অষ্টম অবস্থানে থাকা এনআরজি স্পিনিং মিলসের রফতানি বেড়েছে দশমিক ২৯ শতাংশ।

গত বছরের প্রথম নয় মাসে রফতানীকৃত সুতার আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নবম অবস্থানে ছিল ইসরাক কটন মিলস। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির রফতানি কমেছে ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। দশম অবস্থানে থাকা এমএসএ টেক্সটাইলসের রফতানিও কমেছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ।

স্পিনিং মিলের উদ্যোক্তারা বলছেন, কভিডের প্রভাবে গত বছর এপ্রিল-মে-জুনের সঙ্গে তুলনায় চলতি বছরে একই সময়ে ক্রয়াদেশ কমেছে গড়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ। তাদের প্রত্যাশা ছিল সেপ্টেম্বর থেকে রফতানি আবার বাড়তে শুরু করবে। প্রত্যাশা সম্পূর্ণরূপে পূরণ না হলেও এখন উৎপাদন সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে। তবে মজুদ সুতা বিক্রি প্রায় শেষ বলে জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, ক্রয়াদেশ কমে গিয়ে সুতার মজুদ বাড়তে শুরু করলে বড়-ছোট সব স্পিনারই বিপদে পড়ে যায়। তবে কারখানার আকার ক্রয়াদেশ বিবেচনায় বড় কোম্পানিগুলোর বিপদ বেশি। আর সে বিপদ কাটিয়ে উঠতে আরো বেশকিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সুতার মজুদ বিক্রি হয়ে কারখানা উৎপাদনে ফিরলেও এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোয়। আবার সুতা উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামালের দামও ঊর্ধ্বমুখী।

বিষয়ে ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই মাসে সুতার আমদানি অনেক কমে এসেছে। এখন রফতানির লিড টাইম খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। তাই চীন ভারত থেকে সুতা আমদানি করে সময়মতো পোশাক রফতানি সম্ভব হচ্ছে না। আবার বন্দরে জটও আছে, ভেসেলগুলো সব সঠিক সময়ে পণ্য পরিবহন করতে পারছে না। বর্তমানে সুতা রফতানিকারকদের মজুদও শেষ হয়ে গিয়েছে। আহামরি লাভ হচ্ছে না, কিন্তু কারো কাছেই খুব বেশি পণ্য মজুদ নেই।

তিনি বলেন, মুহূর্তে আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো পণ্যের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। কভিডের পরে তুলার দাম প্রতি পাউন্ডে ১০-১৫ সেন্ট বেড়েছে। কেজিতে বেড়েছে ২৫ সেন্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন