প্রবীণের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামাজিক আন্দোলন জরুরি

হোসনে আরা আক্তার

বার্ধক্য মানুষের জীবন চক্রের একটি অপরিহার্য অংশ৷ আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে৷ একই সঙ্গে ছোট পরিবার গড়ে তোলার কারণে কমছে স্বল্পবয়সী যুবক-যুবতির সংখ্যা৷ ফলে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশেও একইভাবে ঘটছে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন৷ নীতি-নির্ধারকদের গবেষণা রিপোর্টে এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পিরামিড কাঠামোতে দেখা দেবে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন৷ জাপানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বয়োজ্যেষ্ঠ৷ এই পরিবর্তনের ঢেউ বিশ্বব্যাপী, যার ফলে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক নীতি-নির্ধারণে এ বিষয়টি বিশেষ তাত্পর্য্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷ বয়োবৃদ্ধির এই ধারায় দেশে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে৷ গড়ে তুলতে হবে প্রবীণদের জন্য প্রাথমিক চিকিত্সা কেন্দ্র, নিশ্চিত করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা ব্যবস্থা৷ সর্বোপরি প্রবীণদের সেবায় গড়ে তুলতে হবে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী এবং বৃদ্ধনিবাস৷

বাংলাদেশে প্রবীণদের বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে মোট জনসংখ্যার ৮ শথাংশ বয়োজেষ্ঠ্য, যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ৷ বর্তমান গড় আয়ু ৭১ বছর৷ সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্টে ২০৫০ সালে দেশে বয়োজ্যেষ্ঠের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছবে, যা মোট জনসংখ্যার ২৫.৯০ শথাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে (Ref: Ageing population in Bangladesh; Health Age Asia, 2019)৷ এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যাকে ধরা হয়েছে৷ সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রবীণদের কল্যাণে তেমন কোনো সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি৷ প্রবীণদের কল্যাণে যে সমস্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন যেমন, বৃদ্ধদের জন্য প্রথমিক চিকিত্সা ব্যবস্থা, বৃদ্ধনিবাস, দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা ব্যবস্থা, আর্থিক সমর্থন, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। অধিকন্তু এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী ষাটোর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল অবস্থার ভিতর দিয়ে দিনযাপন করে৷ শহরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝে এই অবস্থা তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও নিম্নবিত্ত ও গরীব জনগোষ্ঠির মাঝে বঞ্চনার এই মাত্রা দৃশ্যমান৷ ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের জনগণ পারিবারিকভাবে প্রবীণদের প্রতি যত্নশীল ও শ্রদ্ধাশীল হলেও আর্থ সামাজিক পরিবর্তনের কারণে দিন দিন এই অবস্থার অবক্ষয় হচ্ছে৷ উচ্চশিক্ষা, চাকরি, ছোট পরিবার, অভিবাসন ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদির কারণে পারিবারিক এই ঐতিহ্য ক্রমশ বিনষ্ট হচ্ছে৷ ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠি অনেকটা অবহেলা ও নিঃসঙ্গতায় জীবন অতিবাহিত করছে৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠি গ্রামের দরিদ্র অধিবাসী হওয়ায় প্রবীণ বয়সে সেবা যত্নের সুবিধা পাওয়ার বঞ্চনা আরো প্রকট৷ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধীর গতি এবং এর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় সঠিকভাবে না পৌঁছানোর কারণে এই প্রবঞ্চনার আরো একটি কারণ৷ গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থসেবা এমনিতেই নাজুক, তার ওপর প্রবীণদের জন্য আলাদা কোনো চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে৷ দেশে বিরাজমান বেকারত্বের কারণে অনেক যুবক-যুবতীর কর্মহীন হতে দেখা যায়৷ ফলে তাদের পক্ষে বৃদ্ধ মা-বাবার খরচ বহন করাও অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়ে৷ যার ফলে নিম্নবিত্ত ও গরীব জনগোষ্ঠির অনেক প্রবীণ ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে৷ কর্মহীন জনগোষ্ঠির এই চাপে সমাজে নানারূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়৷ 

বাংলাদেশের সামাজিক ঐতিহ্যে সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা পুত্রসন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ প্রবীণ বয়সে পিতা-মাতা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়৷ তার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ক্ষয়, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, কিডনির অকার্যকারিতা, ক্যান্সারসহ নানারূপ বার্ধক্যজনিত রোগ৷ পরিবারে যথার্থ উপার্জনক্ষম সন্তান না থাকলে পিতামাতার ভরণপোষণের পর এই সমস্ত ব্যয়বহুল খরচের চিকিত্সা ব্যয় বহন করা অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়ে৷ এর ফলে প্রবীণ ব্যক্তি নিজের পরিবারে আপনজন কর্তৃক নানা অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার হন৷ অনেক পরিবারে এমনও দেখা যায় পিতা-মাতাকেই বৃদ্ধ বয়সে সন্তান-সন্ততির ব্যয়ভার বহন করতে হয়৷ সে কারণে আমরা অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও উপার্জনের জন্য রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা কিংবা অন্য কোনো কায়িক পরিশ্রমে জীবন যাপন করতে দেখি৷ এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারকদের পূর্ব থেকে সতর্ক না হলে আগামী সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে৷

ভৌগলিক ও জলবায়ুজনিত প্রভাব

ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রকৃতিক বিপর্যয় একটি সাংবাত্সরিক বিষয়৷ প্রতিবছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড় ও নদীভাঙ্গনে ভিটে-মাটি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ৷ এইসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠি৷ ক্ষুধা, আশ্রয়হীনতা, রোগ-শোকে আক্রান্ত এই জনগোষ্ঠিকে রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে সাহায্য দেয়া হয় তা চাহিদার তুলনায় একবারে অপ্রতুল৷ ফলে জীবন-ধারনের জন্য এই জনগোষ্ঠি আশ্রয় নেয় ভিক্ষাবৃত্তিতে৷ ক্ষুধা, আর্থিক সামর্থ্যহীনতা, আশ্রয়ের অভাবে প্রবীণ এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷ বাংলাদেশে আশ্রয়হীন এসব জনগোষ্ঠির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান অদ্যাবধি তৈরি করা হয়নি৷ উপকূলীয় অঞ্চলে জনগোষ্ঠি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত৷ এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দক্ষিণঅঞ্চলের জনজীবনে নিরাপদ পানির তীব্র অভাব রয়েছে৷ 

বয়স্কদের প্রতি নিপীড়ন

Help Age Global Network-এর গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বব্যাপী প্রতি ৬ জন প্রবীণ ব্যক্তির মধ্যে একজন নীপিড়নের শিকার হচ্ছে৷ এই তথ্য সত্য হলেও বাস্তবে বৃদ্ধদের প্রতি নিপীড়ন অনেকটাই দৃশ্যের আড়ালে থেকে যাচ্ছে৷ 

বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন ঘটনায় বৃদ্ধদের প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও অবহেলা বৃদ্ধির চিত্র ক্রমাগত পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ মিডিয়ার বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে, চলাচলে অক্ষম বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তান-সন্ততিরা কোনরূপ ভরণপোষণ করছে না এবং কখনো কখনো রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন কিংবা বাসস্টেশনে ফেলে নিরুদ্দেশ হচ্ছে৷ এসব পিতা-মাতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্মৃতিভ্রষ্ট থাকে কিংবা রাস্তাঘাট অপরিচিত থাকায় নিজের আশ্রয়স্থলে ফিরে যেতে অক্ষম৷ বৃদ্ধদের প্রতি এ ধরনের আচরণ পরিবারের অতি নিকটজন যেমন করে থাকে তেমনি বৃদ্ধাশ্রম ও অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচর্যায় নিযুক্ত সেবাকর্মীর মাধ্যমেও হতে পারে৷

বিশ্ব প্রবীণ দিবসে এ ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং নিপীড়ন বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে৷ প্রকৃত সত্য হচ্ছে পিতা-মাতার প্রতি এ ধরনের নিপীড়ন বন্ধে বাংলাদেশ সরকার পিতামাতা ভরণ পোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করে থাকলেও বাংলাদেশের নিপীড়িত পিত-মাতারা সন্তানের বিরুদ্ধে কোনরূপ আইনের আশ্রয় নিতে চায় না৷

পরিবার ও বৃদ্ধাশ্রমে সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তির মাধ্যমে প্রবীণ জনগোষ্ঠি নিম্নরূপভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে: 

শারীরিক সহিংসতা: শারীরিক আঘাত, ক্ষতিকর ড্রাগের ব্যবহার, আশ্রয়স্থলে কিংবা অন্য কোনোভাবে আবদ্ধ করার মাধ্যমে৷

আবেগপূর্ণ: ভীতিপ্রদর্শন, অবমাননা করা, অকারণে প্রাত্যহিক দোষারোপ, অবহেলা, ভর্ৎসনা, পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে পৃথক করে রাখা৷

যৌন নিপীড়ন: আশ্রয়কেন্দ্রে সেবাদানকারী ব্যক্তির মাধ্যমে কিংবা পরিবারে নিকটাত্ম্বীয়ের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার৷

অবহেলা: ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সঠিকভাবে খাদ্য, নিরাপদ পানি, আশ্রয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না করা, প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কর্মে কিংবা অন্যসব জরুরি কর্মে সহায়তা না করার মাধ্যমে৷

আর্থিক প্রবঞ্চনা: বৃদ্ধ কিংবা প্রবীণ ব্যক্তির অগোচরে তার অর্থকড়ি, সম্পদ ভোগ করা এবং অর্থের ব্যবহারে তাদের সম্মতি না নেয়ার মাধ্যমে৷

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গৃহীত সরকারি ব্যবস্থা

বাংলাদেশ সরকার দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠি সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এবং পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি চালু করে৷ ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ৪৯ লাখ বয়স্ক ব্যক্তির জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে৷

বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতাকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ‘পিতামাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে৷ এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে, পিতামাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে, পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না, পিতা-মাতার চিকিত্সাসেবা ও পরিচর্যা করবে৷ পিতামাতার অবর্তমানে বৃদ্ধ দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরন-পোষণ করবে৷ এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে৷

সরকার প্রবীণদের কল্যাণে নানা কর্মসূচি চালু করলেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা নিতান্তই অপ্রতুল৷ প্রবীণরা সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক৷ তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও মেধাকে নিয়োজিত করে সমাজের ইতিবাচক কল্যাণ ও সুফল বয়ে আনতে পারে৷ সমাজে প্রতিটি প্রবীণের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে পরিপূর্ণ জীবন ভোগ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে৷ তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে হবে৷

হোসনে আরা আক্তার

সভাপতি, পূর্ণায়ু সিনিয়র সিটিজেনস সমাজকল্যাণ সংস্থা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন