পাহাড়ে জুম চাষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায়

ড. মো. জামাল উদ্দিন

‘মোনো উগুরে ঝুম গুচ্চে, ইক্কে ইদু আমা ঘর’ এটা একটি চাকমা ভাষায় রচিত জুম চাষের ওপর অত্যন্ত প্রচলিত ও আবেগঘন গানের প্রথম লাইন যার বাংলা অর্থ, ‘পাহাড়ের উপরে জুমের চাষ করেছি, এখন আমাদের বাড়ি এখানে’। এ থেকে বুঝা যায় জুম চাষ পাহাড়ি সম্প্রদায়ের আত্মার একটি বন্ধন। এটি তাদের কৃষ্টি কালচারের সঙ্গে মিশে আছে একাকার হয়ে। বেশিরভাগ উপজাতী সম্প্রদায় জুম চাষকে তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। জুম চাষকে তাই তারা ‘ফুড ব্যাংক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। কারণ এক পাহাড়ে একই সঙ্গে অনেক ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে। এই জুম চাষকে একেক উপজাতী সম্প্রদায় একেক নামে ডাকে, যেমন- চাকমা ভাষায় ঝুম, মারমা ভাষায় ইয়াঁ, ত্রিপুরা ভাষায় হুগ, ম্রো ভাষায় উঃঅ, খিয়াং ভাষায় লাই, বম ভাষায় লাও এবং বাংলা ভাষায় জুম বা জুম চাষ। জুম চাষ বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি।

পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জুম ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অতীব জরুরি। করোনাকালীন সময়ে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। 

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতে, এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি থাকে সেটার বাস্তবায়ন যেমন জরুরি তেমনি প্রতি একক আয়তনের জমির ফসলের ফলন বৃদ্ধিও জরুরি। প্রতি একক আয়তনের ফসলের ফলন বাড়ানোকেই উক্ত ফসলের উৎপাদনশীলতা বলা হয়। জুম চাষ যেহেতু সনাতনি পদ্ধতিতে চাষাবাদ থাকে। তাই এর গড় ফলন ও কম। তবে ফলন কম হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেমন- পাহাড়ের মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়া, একই পাহাড়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার জুম চাষ করা, সহজলভ্য না হওয়ায় উন্নতজাতের বীজ ব্যবহার না করা, সঠিকভাবে বীজ উৎপাদন বা সংরক্ষণের আধুনিক ধারণা বা সুযোগ না থাকা, জুমে সার ব্যবহারের আধুনিক উপায় উদ্ভাবন না হওয়া বা সনাতনি পদ্ধতিতে সার ব্যবহার করা (যেমন টিএসপি ও এমওপি সার, ধানসহ অন্যান্য বীজের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করে। আর ইউরিয়া সার ধানসহ অন্যান্য বীজ লাগানোর ১৫-২০ দিন পর পাহাড়ের গায়ে ছিটিয়ে দেয়)। বেশিরভাগ জুম চাষী সার ব্যবহার না করা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের ওপর তেমন কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া বা ধারণা না থাকা, বালাই দমনের ওপর সঠিক এবং সমন্বিত উপায় উদ্ভাবন না হওয়া, যদিও কিছু কিছু প্রকল্পের ওপর গবেষণা করেছে। কিন্তু এর ফলাফল এখনো জুম চাষীদের মাঝে তেমন পৌঁছায়নি। তাছাড়া অতি বৃষ্টি এবং মাঝে মাঝে অতি খরা ফলন কম হওয়ার জন্য দায়ী। জুম ফসলের উৎপাদনশীলতা বা ফলন বৃদ্ধির নানাবিধ উপায় আছে। তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারলে প্রতি ফসলের ফলন বাড়ানো কঠিন কাজ নয়। সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আগে জুম চাষ সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া সমীচীন মনে করি। 

তিন পার্বত্য জেলার (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) মোট আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। যার প্রায় ৫ হাজার ৪৮০ বর্গকিলোমিটার পাহাড়জুড়ে জুম চাষ করা হয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে ঢালু পাহাড়ের উপর জুম চাষ করা হয়। কয়েক বছর (বর্তমানে ১-৩ বছর) পর পর পাহাড় পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হয় বলে ইংরেজীতে একে শিফটিং কালটিভেশন বলে। চাষাবাদের আগে জঙ্গল কেটে শুকিয়ে পুড়িয়ে নিতে হয় বলে একে ক্র্যাশ (কাটা) অ্যান্ড বার্ন (পুড়ানো) এগ্রিকালচারও বলা হয়। 

জুম চাষের উৎপত্তি সুইডেন থেকে। তাই একে সুইডেন এগ্রিকালচারও বলা হয়। বাংলাপিডিয়া মতে, বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে জুম চাষ হয়। ২০১৭ সালের তথ্য মতে, তিন পার্বত্য জেলায় ৩৫ হাজারেরও বেশি জুমিয়া পরিবার এই জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি, ২০২০ এর তথ্যমতে, তিন পার্বত্য জেলায় মোট জুমিয়া কৃষকের সংখ্যা ৪২ হাজার ৯৩৭ জন। তার মধ্যে বান্দরবান ১৫ হাজার ০৪৮ জন, খাগড়াছড়ি ৪ হাজার ৩৯০ জন এবং রাঙ্গামাটিতে ২৩ হাজার ৫০০ জন প্রায়। এখানে জুমিয়া পরিবার বলতে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল পরিবারকে বুঝায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের বসবাস তারা বেশিরভাগ সার্বিকভাবে জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল যেমন: মুরং, খেয়াং ও লুসাই সম্প্রদায় এবং আরো অনেকে।

প্রকৃত অর্থে জুম চাষ বলতে পাহাড়ের জঙ্গল কেটে শুকিয়ে অতঃপর পুড়িয়ে পরিষ্কার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ করাকে বুঝায়। একটি পাহাড়ে চাষাবাদ করার পর সেটার উর্বরতা বৃদ্ধি করার জন্য ১-৩ বছরের জন্য রেখে দিয়ে, আবার অন্য পাহাড়ে গিয়ে একই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করাই হলো জুম চাষ। জুমে নানাবিধ ফসল চাষ হয়ে থাকে তার মধ্যে- স্থানীয় এবং উফশী জাতের ধান, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, চিনাল, অড়হর, শিম, শসা, করলা, ঢেঁড়শ, তিল, ভুট্টা, মরিচ, কাউন, বিলাতী ধনিয়া, করলা, বরবটি, ঝিংগা. চিচিংগা, চাল কুমড়া, কাকরোল, পুঁইশাক, জুমকচু, মুখিকচু, বেগুন, লাউ. ধুন্দল, আদা, হলুদ, যব, তুলা, পাহাড়ি আলু যা ঠাণ্ডা আলু হিসাবে পরিচিত, চুকুর, জোয়ার ও গাঁদা ফুল ইত্যাদি। তবে এসব ফসলের মধ্যে জুম ভেদে এর সংখ্যা নির্ভর করে। ২০০৯ সালে জুমের ওপর আমার নিজের পিএইচডি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, প্রায় প্রতিটি জুমের পাহাড়ে ১৮ রকমের ফসল চাষ করতে দেখা গেছে। সময়ের বির্বতনে হয়ত এর সংখ্যা বর্তমানে কমে এসেছে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জুমের ফসল কাটার মৌসুম। তবে একেক সময় একেক ফসল সংগ্রহ করা হয়। ফ্রেব্রুয়ারি-মার্চ-এর দিকে জঙ্গল কেটে, শুকিয়ে নেয়। অতঃপর পুড়িয়ে পরিষ্কার করে। প্রথম বৃষ্টি শুরু হবার পর এপ্রিল-মে মাসে প্রায় সব ফসলের বীজ বপন করা হয়।

জুম চাষের পদ্ধতিও ভিন্ন রকম। যেমন-পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য এক টুকরো পাহাড় নির্বাচন করা হয়। পাহাড় নির্বাচনের সময় গাছ, বাশঁ, ঝাড়-জঙ্গল ও আগাছাসহ পাহাড়ের ঢালু জায়গাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তারপর সেই জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাশঁ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। কাটার পর সেগুলো রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণতঃ চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেইসঙ্গে ওপরের ১-২ ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়া মাটির জন্য জমি উর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়। মরিচ বা বেগুনের অর্থাৎ ছোট বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়। আর ধানসহ অন্যান্য ফসলের বীজ একত্রে মিশিয়ে নির্র্দিষ্ট পরিমান বীজ একটি গর্তের মধ্যে দেয়া হয়।  চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণতঃ প্রস্তুতকৃত জমিতে ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। বীজ বপনের জন্য ‘দা’ নামে পরিচিত একটি প্রশস্ত ব্লেডের ছুরি ব্যবহৃত হয়। বাঁ হাতে দা-এর মাথা দিয়ে মাটি ফাঁক করে তাতে একত্রে মেশানো বীজ পরিমাণ মতো ডান হাত দিয়ে ঢেলে দেয়া হয়। তারপর দা তুলে নিলে মাটিতে আপনাআপনি বীজগুলো ঢেকে যায়। এ বপন পদ্ধতি আদিম। একই গর্তে অনেকগুলি বীজ এক সঙ্গে বপন করার কারণে স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে খাদ্যের প্রতিযোগিতা হয়। যদি জমির উর্বরাশক্তি কম হয় তাহলে ফলনও কম আসে। বিভিন্ন ফসল আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যবর্তী সময়ে পরিপক্ব হয় এবং পর্যাক্রমে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়।

পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে জুম ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অতীব জরুরি। জুম চাষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য যা করণীয় তা হলো- উর্বরতাশক্তি সম্পন্ন পাহাড় নির্বাচন করা যদিও বর্তমানে এটা বেশ কঠিন, উন্নত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করা ও বপন করা বিশেষ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উফশী জাতের আউশ ধান যেমন বিআর ২৬, ব্রি ধান ২৭, ব্রি ধান-৪৮. ব্রি ধান-৫৫ আর স্থানীয় উন্নত জাতের ধান ককরু, গ্যালেন এবং শেরে ধান উল্লেখযোগ্য। 

কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সিআরপি প্রকল্পের কম্পোনেন্ট-৩-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব জাতীয় ধানের ফলন স্থানীয় জাতের ধানের চাইতে অপেক্ষকৃত বেশি যা প্রতি হেক্টরে ২.০৩-২.৭৩ টন (প্রায়)। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর উৎপাদনশীলতা আরো বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় উন্নত জাতের ধান যেমন ককরু, গ্যালেন এবং শেরে এই তিন প্রজাতিসহ আরো উন্নতজাতের স্থানীয় ধানসমূহকে গবেষণার প্রধান খাতে নিয়ে এসে এর ফলন বাড়ানোর গবেষণা করা যেতে পারে। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘মাউন্টেইন এগ্রিকালচার-২০১৯-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে জুম ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ২.৫-৩.০ টন যা একই মৌসুমের উচ্চ ফলনশীল ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ৩.৫-৪.০ টন। অর্থাৎ ফলন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। জুম ধানের পাশাপাশি জুমের অন্যান্য ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে স্থানীয় উন্নত জাতসমূহ বাছাই করে ফলন বৃদ্ধির উপর গবেষণা করে পূনরায় জুমে চাষ করার জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে। এছাড়া জুমে সার প্রয়োগ ব্যবস্থাপনার ওপর প্রযুক্তি প্যাকেজ উদ্ভাবন ও বিস্তার জরুরি। আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে জুমে নিত্যনতুন রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায়। এর জন্য সমন্বিত বালাইদমন ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি দরকার। একই সঙ্গে জুম চাষের অন্যান্য আন্তঃপরিচর্যাসহ নিয়মিত আগাছা দমনও জরুরি। পরিশেষে, জুম ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে জুমিয়াদের যেমন ভূমিকা রয়েছে ঠিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব রয়েছে। এ দু’য়ের যৌথ প্রচেষ্টায় কেবল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।


লেখক:

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃষি অর্থনীতিবিদ,

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট,

আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

ই-মেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন