বিশ্লেষণ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি জনশক্তি রফতানির কারখানা?

ড. এ. কে. এনামুল হক

শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? আমরা কী জন্য জীবনের ২২-২৩টি বছর শিক্ষাঙ্গনে কাটাই? ডিগ্রি লাভের জন্য? বন্ধু তৈরির জন্য? আয়ের পথ আবিষ্কারের জন্য? ইংরেজিতে কথা বলার জন্য? নাকি আমরা শিক্ষিত হই মানুষ হিসেবে নিজের মননকে আবিষ্কারের জন্য? প্রশ্নটি আপনার মনে থাকে কিনা জানি না, তবে তা আমার মনে সর্বদাই থাকে। হয়তোবা আমি শিক্ষক বলেই। প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করি, কী করছি?

শিক্ষার ইতিহাস কী বলে? কেন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেছি? একসময় জ্ঞানার্জনকে চার ভাগে ভাগ করা হতো। এক. ধর্মীয় জ্ঞান, যে জ্ঞান দিয়ে আমরা সমাজে মনুষত্ব্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। জেনেছি সৃষ্টিকর্তাকে। বুঝতে চেষ্টা করেছি তার সৃষ্টিকে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছি ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি। দুই. চিকিৎসাজ্ঞান, যা দিয়ে আমরা শিখেছি কী করে মানুষকে রক্ষা করা যায় রোগ-জ্বরা থেকে। তিন. প্রকৌশল জ্ঞান, যা দিয়ে আমরা যন্ত্রের আবিষ্কার করেছি আর মানব জাতিকে কায়িক পরিশ্রম থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পেরেছি। চার. আইন জ্ঞান, যা দিয়েসামাজিক মানুষ’-কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, শিক্ষা মানবজাতিকে প্রাণী জাতি থেকে আলাদা করে থাকে। আমরা শিক্ষিত হয়েছি মানুষ হওয়ার জন্য। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, ভারত, চীন, মিসর, মায়া, বিভিন্ন জাতি শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল মানুষকে শক্তিশালী করতে। আর তা রাজারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই শিক্ষক শিক্ষাগুরুদের বসিয়েছিলেন রাজসভায়। তাদের মন্ত্রণা রাজারা গ্রহণ করতেন সশ্রদ্ধচিত্তে। সে সময় শিক্ষা ছিল একটি রাজকীয় ব্যাপার। সবাই করতে পারত না। যাদের কিছু করার নেই, তারাই তা গ্রহণ করতেন। তবে কালে দেখা গেল, শিক্ষিত হওয়া শুধু রাজদরবারে হাজির হওয়ার জন্য নয়; কল্পনা করা কল্পনাকে লিখে রাখা, আবিষ্কার করা, সমাজের ভালো-মন্দ বিবেচনা করা বা মানুষের -জাতীয় প্রবণতা থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক, লেখক অনেকেই। তারা লিখতেন আপন মনে, নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানোর মতো, তবে তা করে অন্যের মনে আনন্দের বা গর্বের জন্ম দেন তারা। সমাজকে ভালো করেন। মানুষকে পশুত্ব থেকে মুক্ত করেন। তাই দেখবেন ভালো মানুষ হতে হলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়াশোনা চর্চা করা জরুরি।

তবে শিক্ষা সে অবস্থায় থাকেনি। একসময় দেখা গেল বিদেশী প্রভুদের ভৃত্যের প্রয়োজন। প্রচুর ভৃত্য। তোতা পাখির কাছাকাছি ভৃত্য। তারা বুঝবে সবকিছু, মনিবকে জানাবে সবকিছু, কিন্তু ভালো-মন্দ চিন্তা করতে পারবে না। আমাদের উপমহাদেশে সেই শিক্ষার আরেক নাম বিএ পাস করার শিক্ষা! শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রধান কাজ ছিল শিক্ষা শেষে ঔপনিবেশিক প্রভুদের তৈলমর্দন করা আর দেশের লোকজনকে তাচ্ছিল্য করা। সাধারণ মানুষকে অমানুষ মনে করা। শিক্ষাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেন আমরা শিক্ষা থেকে জ্ঞানকে আলাদা করে দিই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রভুদের উচ্চতর আসন বসিয়ে তাদের পদলেহন করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অনেকেই তা গ্রহণ করতে পারেননি। তাই ইতিহাসের বহু জ্ঞানী জন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রভুভক্ত কুকুর হতে পারেননি। নেতাজি সুভাষ বোস তাদের একজন। মোজাফফর আহমেদ তাদের একজন, সূর্য সেন তাদের একজন। আরো আছেন নাম না জানা হাজার হাজার বাঙালি, যারা শিক্ষিত হয়ে জনগণের চোখ-কান খোলার জন্য চলে এসেছিলেন গ্রামে। নেমেছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। তাদের ধারণা ছিল, চোখ-কান না খুললে সমাজ এগোবে না। তাদের ধারণা ভুল ছিল না। ঔপনিবেশিক প্রভুরা দেশ ছাড়লেন বা ছাড়তে বাধ্য হলেন। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বদলালো না। ঔপনিবেশিক শিক্ষাই রয়ে গেল। ভৃত্য এবার প্রভু হিসেবে আভির্ভূত হলেন। তাদের আচরণে জ্ঞানের লেশমাত্র নেই। তবুও তারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তারা মানুষকে দেখেন শিকার হিসেবে। আসুক আমার কাছে, তাকে সাপের পাঁচ পা দেখিয়েই ছাড়ব। এসব নব্য প্রভুর শক্তি আর সামর্থ্যকে অস্বীকার করার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলে নিজেও সেই লেজ কাটা শিয়ালের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সবারই এক লক্ষ্যআমিও হব। কত টাকা লাগবে? আমাকে প্রভু হতেই হবে। একসময় প্রভুত্ব শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যেত, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হলো টাকা। আমি যাদের কথা বলছি, তারা আমাদের ছাত্র, সন্তান কিংবা মামা-চাচা। তবে এদের মধ্যেও সবাই অমানুষ হয়নি। এখনো মানুষ রয়েছে। এখানেই মাহাত্ম্য। শিক্ষা কারো কাছে হয় সুশিক্ষা আর কারো কাছে কুশিক্ষা। যশোরের শিশু (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে কিশোর হত্যার ঘটনা আমাকে তা- মনে করিয়ে দেয়।


আমরা যারা শিক্ষকতা করি, আমাদের উদ্দেশ্য এখন মানুষ তৈরি করা নয়। মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়। আমি নিশ্চিত নই, আমরা কি জ্ঞানদান করি, নাকি শিক্ষাদান করি? আমাদের উদ্দেশ্য ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা। ব্যক্তির প্রতিষ্ঠায়ই আমার গর্ব হয়। আমার ছাত্র কোটিপতি, তাতেই আমি গর্বিত। কী করে কোটিপতি হলো, তা নিয়ে আমিও এখন প্রশ্ন করি না। করার ক্ষমতাও হারিয়েছি। কেন এমন হলো? কী করে আমরা রাজদরবার থেকে রাস্তায় নেমে এলাম? আমিও কি জৌলুস হারিয়েছি? আমাকে দেখে কি সবাই মনে করে আমার কাজটি সবচেয়ে সহজ? কে শিক্ষক? যার অন্য পেশায় যাওয়ার যোগ্যতা নেই, তিনি? নাকি যে জীবনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অপারগ, তিনি? নাকি যার একমাত্র পুঁজি ২২-২৩ বছরের মুখস্থ বিদ্যা?

এতগুলো প্রশ্ন রাখলাম এই কারণে যে শিক্ষা তথা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনা জরুরি। নচেৎ পতন অনিবার্য। দেশের সর্বোত্তম বিদ্যাপীঠের অবস্থা কী, তা আমরা এতদিনে জানি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে মানুষ গড়ার কারিগর না হয়ে মানুষ বিক্রির কারখানায় রূপান্তর হয়েছে। কিছুদিন আগে এক সম্মেলনে বলেছিলাম, যদি লক্ষ টাকার সরকারি ভর্তুকি নিয়ে পাস করা ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত ভিন দেশে গিয়েই চাকরি করে, তবে আমাদের জনগণের করের টাকা কিন্তু সেই দেশেই চলে যায়। আমরা কেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়কেই ভালো বলি, যখন দেখি সেখান থেকে পাস করে ছাত্ররা বিদেশে চলে যেতে পারে? সেটাই যদি আমাদের গর্বের বিষয় হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জনশক্তি রফতানির কারখানা বলা ভালো। দেশের কাজে যাদের শিক্ষা ব্যবস্থা লাগে না, সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন সরকার ভর্তুকি দেবে? আমি তো মনে করি না। আপনি কী বলেন?

প্রতি বছর দেশে লক্ষ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। কেন? কারণ নতুন প্রযুক্তি উৎপাদন আমাদের দেশে হয় না। হয় বিদেশে আর সেই আমদানি দিয়ে আমাদের শিল্প-কারখানা কি-ইবা লাভ করতে পারে? গত ৩০ বছরে আমাদের সিংহভাগ যন্ত্রপাতি এসেছে গার্মেন্ট শিল্পে, কিন্তু শিল্পের যন্ত্রপাতির কোনো পরিবর্তন আমরা করতে পারিনি। কারণ? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তা নেই। গত ৩০ বছরে গার্মেন্ট শিল্পে আমাদের যে পরিমাণ লাভ হয়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে, সেই তুলনায় আমরা কি শিক্ষা পাঠক্রমে কিছু চালু করেছি? না। কারণ? আমাদের পাঠক্রম আমার দেশের প্রয়োজনে তৈরি হয় না। পাঠক্রম তৈরি হয় পাস করা যুবকদের বিদেশে রফতানি করার উদ্দেশ্যে। অধুনা আমাদের লক্ষ্য হয়েছে বিদেশী শিক্ষামান সার্টিফিকেট কেনার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলছে ডলার খরচ করে বিদেশী মান সার্টিফিকেট কেনো। বলছে না, দেশের উপকারের স্বার্থে মান উন্নত করো। কভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারের দৌড়ে রাশিয়া সফলতা লাভ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি খুব নড়বড়ে? তারা কি বিদেশী শিক্ষামান গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে দৌড়াচ্ছে?

আমাদের উদ্দেশ্য আমাদের ছাত্ররা যেন পাস করে বিদেশে গিয়ে বলতে পারেএই বই তো আমি আমার দেশেই পড়ে এসেছি। তাই এখানে ভালো করতে পারছি। দেশের (বিদেশের) উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারছি। ধন্য আমাদের শিক্ষায়তনআমার ৯০ শতাংশ ছাত্র যারা দেশে পড়ে রইল, তাদের জন্য কিছু না করে যারা দেশের বাইরে চলে যাবে, তাদের জন্য করা কি দেশের জন্য মঙ্গলের হল? আমাদের দেশে পড়ে থাকা পাস করা ছাত্ররা যখন দেখে যে তার দ্বারা কিছুই করা সম্ভব নয়, তখন সে আর কী করবেউঠে পড়ে নৌকায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্রেভাগ্যে যা হয়। কখনো ধরা পড়ে মাঝসমুদ্রে। ধরা পড়লে বেঁচে যায় আর না পড়লে হয় সলিল সমাধি। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের নামে বিদেশী পাঠক্রম নকল করে কি দেশের কোনো লাভ হবে? সব শেষে আবারো বলি, বিদেশে পাঠানোই যদি আমাদের শিক্ষা পাঠক্রমের লক্ষ্য হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম পাল্টে বলুন এগুলোজনশক্তি রফতানির কারখানা

 

. . কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন