সরকারি ক্রয় নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিকল্পনামন্ত্রী

শুধু সতর্ক নয়, দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ক্রয়ে উচ্চব্যয়ের অভিযোগ ওঠায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় আরো স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি উচ্চব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। সরকারি প্রকল্পে উচ্চব্যয় অপব্যয়ের বিষয়টি পুরনো হলেও পর্দা, বালিশ, বঁটি ইত্যাদি কেলেঙ্কারির পর তা সামনে এসেছে বেশি। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং অনেক ধাপ থাকলেও এক্ষেত্রে দুর্নীতি মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এখানে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। কারণে সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগও এখানে কাজে আসছে না। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এখন মহীরুহ রূপ নিয়েছে। ক্রয় প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে কাজ দেয়া, গুটি কয়েক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার মতো ঘটনার সঙ্গে যোগ হয়েছে পণ্য সরবরাহ না করে অর্থ উঠিয়ে নেয়া। অধিক দামে পণ্য ক্রয় এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে অর্থ ব্যয় না করেও বিপুল ব্যয় দেখিয়ে অর্থ উঠিয়ে নিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। পরিকল্পনামন্ত্রী সচিবদের এক বৈঠকে এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কথা বলেছেন।

সরকারের উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় সরকারি ক্রয়ে। জনগণকে বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করার জন্য সরকার এডিপির আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত অনিয়ম দুর্নীতি রোধ করে -টেন্ডারিংসহ ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে জনবান্ধব ক্রয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব। জনবান্ধব ক্রয় ব্যবস্থাপনা থাকলে হাজার টাকার পণ্য ৩০ হাজার টাকায় কিনতে পারবেন না কোনো অসৎ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। পিপিআর সঠিকভাবে অনুসরণ না করা হলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন চলাকালেই কয়েকবার ব্যয় বাড়িয়ে নেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি, যাতে নির্দিষ্ট কোনো ঠিকাদার বা বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ না পায়। নতুন ঠিকাদার যাতে কাজ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন না থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের চাপে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনা নির্মাণ করতে হয়। নির্মিত স্থাপনার উপযোগিতা না থাকলে সেটির দায় নেয়ার বিধিও পিপিআরে সংযোজন করতে হবে।

দুর্যোগকালে সংকটের দ্রুত উত্তরণের স্বার্থে কখনো কখনো ক্রয় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার প্রয়োজন হবে, কিন্তু এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্রয় প্রক্রিয়ায় সব ধরনের যোগসাজশ, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থের সংঘাত অতিমূল্য নির্ধারণ প্রবণতা প্রতিরোধে যেকোনো ধরনের ভয়-ভীতি স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থেকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অধিকতর স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা জনগণের কাছে সরকারের পাশাপাশি দাতা সংস্থার ওপর জনগণের আস্থা বাড়াবে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। তাই আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সব ধরনের প্রকল্প উদ্যোগের সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কঠোর দুর্নীতিবিরোধী মানদণ্ডের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপচয়, দুর্নীতি ব্যয় বাহুল্যের কোনো সুযোগ থাকা মোটেই সমীচীন নয়। অথচ দুর্ভাগ্যবশত আমরা বিপরীত চিত্র দেখেই অভ্যস্ত। এর নমুনা দেখতে আমাদের খুব পেছনে যেতে হয় না। আর বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাপারে নির্দেশ দিতে হয়েছে। খুবই সত্যি যে যথাযথভাবে অর্থের ব্যবহার না হওয়া এবং অনিয়ম দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র মোটেও সুখকর নয়। দেখা যায়, বাস্তব প্রয়োজন বিবেচনা না করে অর্থ খরচ এর মাধ্যমে প্রাপ্তিযোগের কথা মাথায় রেখে বহু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তারপর আছে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম দুর্নীতি। কিছুদিন আগেই এডিপি বরাদ্দের ঘোষণা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) উদাসীনতার কারণে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না। ফলে ব্যয় বৃদ্ধির নামে সরকারের অর্থের অপচয় হয়। চলমান প্রকল্পে নতুন কম্পোনেন্ট যোগ করে বারবার ব্যয় বাড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও রয়েছে বহু প্রশ্ন। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের গাফিলতি শুধু নয়, দুর্নীতিরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। সরকারি ব্যয় বাহুল্য অপচয়ের আরো কিছু বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। সরকারি ক্রয়ে উপযোগিতা যাচাই মান নিশ্চিতকরণে দুর্বলতা, সরকারি সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে অব্যবস্থাপনা এবং এসবের পরিণামে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের এসব দৃষ্টান্ত আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য উদ্বেগের বৈকি।

দেশের অগ্রগতি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্র তথা সরকারের পরিকল্পনাটাই আসল। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে জনগণের মুখে হাসি ফোটে, আর ব্যত্যয় ঘটলে জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হয়। ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আর আমাদের মতো দরিদ্র দেশে উপযুক্ত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের সাধারণ মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার হোক, এটাই সবার চাওয়া। আমরা আশা করব রাজনৈতিক বা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ বিবেচনা নয়, জনগণের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হবে। যথাসময়ে মানসম্মতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা সচেষ্ট থাকবেন। ব্যাপারে তদারকি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সর্বক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের সাশ্রয়ী ব্যবহার অপচয় রোধ অপরিহার্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন