আমার ঈদের জামা

শামীম আজাদ

আম্মার কালো রঙের হাতির শুড়ের মতন একটা সিঙ্গার সেলাই কল ছিল। সেটার ডান দিকে রূপালী চাকার মধ্যে হ্যান্ডেল। আম্মাকে সাহায্য করতে মাঝে মাঝে আমরা তা ঘুরাতাম। যা মজা লাগতো! 

আমাদের ঈদের সব জামা তিনি বাসায় তৈরি করতেন। একবার আমরা যখন জামালপুরে ছিলাম আব্বা ছিলেন মহকুমা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কিন্তু সৎ অফিসার বলে তার নামডাক ছিল। তখন মেয়েরা বাজারে যেত না। আব্বা ও সামাদ চাচা একসঙ্গে ঈদের বাজার করতেন। ট্রাঙ্ক রোড থেকে সেমাই, পোলাওর চাল আর কাপড় কিনে মন্তাজ ভাইকে দিয়ে পাঠাতেন। 

জামা তৈরির আগে তা সাদা জলে ধুয়ে নিতে হত। শুকিয়ে গেলে তা রোদ থেকে তুলে এনে দিলে আম্মা পাটি বিছিয়ে পেন্সিল, কাঁচি, মাপের জামা ও মাপার ফিতে নিয়ে বসতেন। কাপড় টানা দেয়ার জন্য, এটা ওটা এগিয়ে দেবার জন্য আমি বসতাম অন্যদিকে। আম্মা মাঝে মাঝে উঠে রান্না ঘরে কষা মাংস দেখে আসতেন এবং ফিরে এসে টেবিলের উপরে রাখা মেশিনের হ্যান্ডেল ঘুরাতেন। ঈদের জামার কাটা অতি ক্ষুদ্র অংশও লুকিয়ে ফেলার জন্য আমি ঘুমে মরে গেলেও উঠতাম না। যাতে ঈদের আগে বাড়িতে এলে বন্ধুদের কেউ টের না পায় কি রকম হবে আমার ঈদের জামা! সে এক প্রতিযোগিতা ছিল। 

মনে পড়ে ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় আমার ঈদের জামার ডিজাইনটা ছিল পাকিস্তা্নী হিট ছায়াছবি আরমানের নায়িকা দিবার বোটনেক টেডি কামিজের মত। কথাকলি হলে সিনেমা দেখে লম্বা জুলপিওলা ওয়াহিদ মুরাদের চেহারা দেখে আমরা পাগল হয়ে গেলাম। আমি আর মন্টি সেইসব জামা পড়ে বকুল তলা দিয়ে দর্পভরে হেঁটে গেলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলা্র বোলিং থামিয়ে গাইতো, একেলে না যা না… হামে ছোড় করতুম… কিন্তু ওই টুকুই। ঐ ছিল ইভ টিজিং এর ধরন। 

তাঁর সেলাইয়ে খুব নাম ছিল। ফ্রেমে বাঁধানো ক্রস স্টিচের কাজের জন্য জামাল্পুর বানিজ্য মেলায় তিনি প্রতিবার পুরস্কার পেতেন। তাদের স্টলের নাম ছিল আপওয়া। মানে অল পাকিস্তান উইমেন্স এসোসিয়েশন। কিন্তু তিনি কোন পুরস্কার নিজে নিতেন না। কারণ তখন কোন নারীই ওভাবে জনতার মঞ্চে উঠে নিজ কৃতিত্বের সুফল প্রাপ্তি প্রদর্শন করতে পারতেন না। কেন তা জানতাম না। তাঁর নাম ঘোষনা করা মাত্র আমার আর ভাইয়ার মধ্যে হুটোপুটি পড়ে যেত কে আনবে এসডিওর সঙ্গে হ্যান্ড শেক করে সে পুরস্কার!

কোন কোন ঈদে আম্মা তার পুরানো শাড়ি কেটে নতুন জামা বানিয়ে দিতেন। আমার বুদ্ধিমতি মায়ের করা সে জামাগুলোর ডিজাইন এমন হত যে দেখে বন্ধুরা বুঝতেই পারত না এর রহস্য। আর আমার? ঈদের জামাটা বন্ধুদের কারো মতো না হওয়াই আসল কথা। মনে পড়ছে আরো আগের এক ঈদের কথা। তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ। আমরা মোমেনশাহী ছিলাম। মুমেনুন্নেছা কলেজের উল্টাদিকে আমাদের বাসা ছিল। সে বাসায় একটা সুন্দর ছাদ ছিল। ঈদ উপলক্ষে সে ছাদে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। আমি আর সিমীন নাচতাম। 

আম্মা সে বারের ঈদের জামা তাঁর একটি গোলাপী সবুজ ছাপা ছাপা জর্জেট শাড়ি কেটে বানালেন। অনেক কুঁচি দিয়ে নাচের ড্রেসের মত একটা লংস্কার্ট বানিয়ে তাঁরই হাল্কা গোলাপী সাটিনের এক কামিজ এর ঝুলের কাপড় থেকে বানিয়ে দিলেন হাতাছাড়া পাইপিং দেয়া সুন্দর একটা ওয়েস্ট কোট। নেক লাইনে আর্দালী ভাইকে দিয়ে পুরানো কাপড়ের মার্কেট থেকে কিনে আনা ছোট ছোট গোল গোল আয়না বসিয়ে দিলেন। লাল প্লাস্টিকের রিং এর মধ্যে ঢুকিয়ে কি কায়দা করে যে সেলাই করে তা বসিয়ে দিয়েছিলেন সেই ওয়েস্ট কোটে কে জানে!

অনেক পরে বুঝেছি, সততার সরকারী কর্মচারির বাড়িতে এভাবেই ঈদ আনতে হয়! কিন্তু সব শেষ করে আম্মা যখন বললেন, নাও তোমার ঈদের জামা। এর নাম হল ‘ইরানী ড্রেস’! এই ঈদে তোমার কোন বন্ধুর এমন পাবে না। আমিও মহা খুশি হয়ে ট্রায়াল দিতে আমাদের স্টিলের আলমারিতে লাগানো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আনকমন হওয়া দিয়েই কথা! আমি সেটা পরে সেবার নজরুলের রুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম/ খেজুর পাতায় নুপূর বাজায় নেচেছিলাম। আর উরনী উড়াতে উড়াতে নিজে ঘুরতে ঘুরতে এমন অবস্থা করেছিলাম যে আমাকে থামানো যাচ্ছিল না। আব্বা- আম্মা, সিমীনের বাবা খান চাচা-চাচী সবাই তখন চা সেমাই খেয়ে ছাদের মৃদুমন্দ হাওয়ায় গল্প করছিলেন।।

লন্ডন, ৩১.৭.২০

শামীম আজাদ একজন কবি, লেখক ও গল্পকথক। তিনি বাংলা ও ইংরেজী দু’ভাষাতেই লেখেন। সত্তুরের দশকে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রায়’ শামীম তরফদার নামে প্রবর্তন করেন বাংলাদেশে ফ্যাশান সাংবাদিকতার। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষার অন্যতম কবির গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন