কোরবানির ঈদের আর মাত্র কয়দিন বাকি। প্রতি বছর এ সময় দেশের হাটগুলোয় জমে ওঠে কোরবানির পশুর কেনাবেচা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এবার উল্টো চিত্র বিরাজ করছে। হাটে প্রচুর পশুর সরবরাহ থাকলেও ক্রেতা সংকটে কেনাবেচায় চলছে মন্দা। ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে পাইকারি বিক্রেতারা না আসায় কেনাবেচা জমছে না বিভিন্ন জেলার পশুর হাটগুলোয়। এ অবস্থায় পশু বিক্রি ও দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন খামারিরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
বাগেরহাট: জেলার বিভিন্ন এলাকায় কোরবানি উপলক্ষে খামারিরা তাদের পশু নিয়ে হাটে যেতে শুরু করেছেন। বাজারে পশুর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও, এখনো জমে ওঠেনি বেচাকেনা। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কম গরু কিনছেন, তাই কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না খামারিরা।
বাগেরহাট জেলার অন্যতম বৃহৎ পশুর হাট বেতাগা হাটে প্রচুর পশুর সরবরাহ রয়েছে। হাটে মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু কেনাবেচা নেই। গতকাল হাটে মাত্র ১১টি গরু ও একটি ছাগল বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে খামারিদের মধ্যে। তারা বলছেন, সারা বছর গরু লালন-পালন করি কোরবানির সময় বিক্রি করার জন্য। করোনা আসার পর গো-খাদ্যের দাম বাড়লেও কোনো রকম কষ্ট করে গবাদি পশুকে খাইয়েছি। এখন বিক্রি মৌসুমে হাটে এসে দেখছি ক্রেতা নেই বললেই চলে। কোরবানি ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। এখন ভালো দামে না বিক্রি করতে না পারলে বড় লোকসানে পড়তে হবে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানি উপলক্ষে এ বছর যে গরু কিনেছি, তাতে আমাদের লাভ হবে না। প্রত্যেকটি গরুর দাম ৫-১০ হাজার টাকা কম দিতে চাইছেন কোরবানিদাতারা। তাই গরু কেনা বন্ধ রাখছেন অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী।
বগুড়া: জেলার বিভিন্ন হাটে প্রচুর গরুর আমদানি হলেও সে তুলনায় বিক্রি এবং দাম পাচ্ছেন না খামারিরা। গরু বিক্রি কম ও দাম কমের কারণে লোকসানের আশঙ্কায় আছেন সেখানকার খামারিরাও।
খামারিরা বলছেন, একদিকে নভেল করোনাভাইরাস, অন্যদিকে বন্যা—এ দুই পরিস্থিতিতে গবাদিপশুর খাবার জোগাড় করাটা খুব কষ্টসাধ্য ছিল এবার। কিন্তু হাটে এসে গরুর যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তাতে লোকসানে পড়তে হবে খামারিদের।
বগুড়ার বিভিন্ন হাটে গত কয়েকদিন ধরেই কোরবানির পশু কেনাবেচা শুরু হলেও তেমন জমে ওঠেনি। বগুড়ার মহাস্থানহাট, ঘোড়াধাপ, সাবগ্রাম, সুলতানগঞ্জ, আড়িয়া বাজার, পীরব, সুখানপুকুর হাটসহ সব হাটে গরু, মহিষ, ছাগলের প্রচুর আমদানি দেখা গেছে। কোনো কোনো হাটে পা ফেলার জায়গা না থাকলেও সে তুলনায় বিক্রি একেবারে কম।
বগুড়া শহরের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বাবু জানান, হাটে কোরবানির গরু উঠেছে। মাঝারি মানের গরু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। গরুর আমদানি হলেও সে হিসেবে ক্রেতা নেই।
গরু বিক্রেতা আমজাদ হোসেন জানান, তিনি বগুড়ার মহাস্থানহাটে দুটি গরু নিয়ে যান। ক্রেতারা কম দাম দিতে চাওয়ায় একটি বিক্রি করলেও আরেকটি বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে হয়।
প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য চাহিদা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার গবাদি পশু। তার বিপরীতে ৩ লাখ ৭৬ হাজার গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য গরু প্রস্তুত রয়েছে আড়াই লাখ।
নড়াইল: এ বছর কোরবানিকে সামনে রেখে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি দেশী গরু ও ছাগল মোটাতাজা করেছেন নড়াইলের খামারিরা। সপ্তাহ খানেক আগে থেকে জেলার বিভিন্ন হাটে পর্যাপ্ত পরিমাণ পশু বিক্রির জন্য তোলা হলেও আশানুরূপ ক্রেতা না থাকায় বিক্রি হচ্ছে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলার ৪ হাজার ১১৮ জন খামারি।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর নড়াইলের কৃষক ও খামারিরা কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করেন। গত বছর সাড়ে ১৮ হাজার গরু ও ছাগল মোটাতাজা করেন জেলার খামারি ও কৃষকরা। চলতি বছর ২৯ হাজার ৫৩২টি পশু মোটাতাজা করছেন তারা। কিন্তু করোনার কারণে এবার কোরবানির পশুর চাহিদা বেশ কম।
স্থানীয় খামারিরা জানান, গত বছর ভারত গরু আমদানি কম করায় স্থানীয় গরুর চাহিদা ছিল বেশি। ফলে জেলার খামারিরা ভালো লাভ করেছেন। চলতি বছর জেলার অনেক খামারি গতবারের তুলনায় আরো বেশি গরু মোটাতাজা করছেন। অনেক নতুন খামার গড়ে উঠছে। খামারি ছাড়াও জেলার সাধারণ কৃষকরা বাড়তি আয়ের আশায় বাড়িতে একটি-দুটি করে গরু মোটাতাজা করেছেন। কিন্তু হাটে চাহিদা কম থাকায় এসব পশুর ভালো দাম পাচ্ছেন না কেউই।
স্থানীয় মৌসুম গরু ব্যবসায়ী মনি মিয়া জানান, প্রতি বছরে কোরবানির সময় নড়াইলের হাজার খানেক মৌসুমি গরু ব্যবসায়ী স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে গরু কিনে বাইরের জেলা থেকে আসা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আর সেই গরুগুলো বড় ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে এবং নৌপথে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেন। এতে স্থানীয় কৃষক, খামারি ও ব্যবসায়ীসহ সবাই লাভবান হন। চলতি বছর করোনার কারণে বাইরের ব্যাপারীরা আসছেন না। এজন্য হাটে বেচাকেনাও কম।
দিনাজপুর: জেলার বিরামপুর স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসেছে কোরবানির পশুরহাট। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা না আসায় জমে উঠছে না পশুর হাটে কেনাবেচা। এতে করে পশু বিক্রি করতে না পেরে খামারিরা যেমন লোকসানের আশঙ্কা করছেন, তেমনি হাটের ইজারাদারও লাভ নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
হাটে গরু নিয়ে আসা খামারি শহিদুল ইসলাম ও সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে বাড়তি লাভের আশায় গরু মোটাতাজা করে থাকি। এবারো বেশকিছু দেশীয় গরু মোটাতাজা করেছি, যা বিক্রির জন্য বিরামপুর পশুরহাটে নিয়ে এসেছি। কিন্তু অন্যান্য বছর বাইরের ক্রেতা আসায় বিরামপুরের পশুরহাট ভালোভাবে জমলেও এবার সে রকম কিছু চোখে পড়ছে না।
লক্ষ্মীপুর: দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কোরবানির হাটে পশু বেচা-বিক্রি করেন খামারি মো. আবুল কালাম। প্রতি বছরই তার খামারের পালিত গরু বিক্রিও হয় চড়া দামে। এতে বেশ লাভ করেন তিনি। কিন্তু এ বছর একদিকে ক্রেতা সংকট, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় অনুপাতে ন্যায্য দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এ খামারি।
শুধু মো. আবুল কালাম নন, একই অবস্থা জেলার আরো অনেক খামারির। জেলায় এবার কোরবানির জন্য প্রায় ২৬ হাজার ৮৫৪টি গরু-ছাগল ও ভেড়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কিন্তু ক্রেতা সংকটে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় লোকসানের শঙ্কা ভর করেছে সবার মাঝে।
জয়পুরহাট: জেলার হাটগুলোয় যে সংখ্যক গরু আমদানি হচ্ছে, সে তুলনায় বেচা-বিক্রি একেবারেই কম। শনিবার সকাল থেকে জয়পুরহাটের সবচেয়ে বড় পশুর বাজার নতুনহাট এলাকায় প্রচুর গরু-ছাগল নিয়ে আসেন খামারিরা। সারা দিন হাটে অসংখ্য মানুষের ভিড় থাকলেও শেষ বেলায় দেখা গেছে ট্রাকে ট্রাকে পশু ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন তারা।
জয়পুরহাট সদরের দুর্গাদহ বাজারে ছাগল ব্যবসায়ী নাজমুলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, হাটে ২৬টি ছাগল নিয়ে এসেছিলাম। এর মধ্যে মাত্র তিনটি বিক্রি হয়। অথচ অন্য বছর সব ছাগল বিক্রি করে বাড়ি ফিরতাম।