পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস

রোডম্যাপ না থাকায় বন্ধ ব্যাংকের বিনিয়োগ

হাছান আদনান

দেশের পুঁজিবাজারে সূচকের টানা পতন ঠেকাতে গত ১৯ মার্চ সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন আনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেঁধে দেয়া হয় ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের সর্বনিম্ন দর। রীতিনীতির পরিবর্তন বাজারের বড় পতন ঠেকিয়েছে। কিন্তু লেনদেন নামিয়েছে তলানিতে। হঠাৎ বেঁধে দেয়া ফ্লোর প্রাইস কবে, কীভাবে তুলে নেয়া হবে তা নিয়ে কোনো রোডম্যাপ না থাকায় নতুন বিনিয়োগ না করে হাত গুটিয়ে বসে আছে ব্যাংকগুলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকি, হুঁশিয়ারি কিংবা নির্দেশনা কোনোটিই বাড়াতে পারছে না ব্যাংকের বিনিয়োগ।

ব্যাংকাররা বলছেন, বিএসইসি হঠাৎ করেই ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েছে। পুঁজিবাজার বাঁচাতে এটির প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার কোনো রোডম্যাপ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মতো দেশে রাতারাতি যেকোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। হঠাৎ করেই ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে বাজারে বড় দরপতন হবে। ভয় থেকেই বিনিয়োগ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে ফ্লোর প্রাইস তোলার রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তারা। দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।

বাজারে স্বাভাবিক পরিস্থিতি না ফেরা পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস তোলা হবে না, বলছে বিএসইসিও। তবে সেটি কবে হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। প্রসঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা এরই মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বলেছি, বাজারের সূচকে উন্নতি হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হবে। বাজারের চাহিদাই বলবে, এটি তুলে দেয়ার উত্কৃষ্ট সময় কোনটি। ফ্লোর প্রাইস তোলার দিনক্ষণ এখনই নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়।

দিনক্ষণ ঠিক না করে দিলেও ফ্লোর প্রাইস তোলার বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে বলে মনে করেন দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, বাজারে লেনদেন বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরাতে হলে অবশ্যই ফ্লোর প্রাইস তোলার বিষয়ে রোডম্যাপ দরকার। হঠাৎ করে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে শেয়ারদর পড়ে যাবে। এতে বাজারে আরো বেশি আতঙ্ক তৈরি হবে।

সিটি ব্যাংকের শেয়ারদরের উদাহরণ টেনে মাসরুর আরেফিন বলেন, সিটি ব্যাংকের শেয়ারদর বর্তমানে ১৭ টাকা। অথচ আমাদের ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) ২৯ টাকা। ব্যাংকের সুনাম, বিজ্ঞাপন, মুনাফাসহ অন্যান্য দিক বিচারে বর্তমানে সিটি ব্যাংকের শেয়ার মূল্য সর্বনিম্ন ৩৮ টাকা হওয়া উচিত। বর্তমান বাস্তবতায় হঠাৎ করে যদি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হয়, তাহলে সিটি ব্যাংকের শেয়ারদর ১০ টাকায় নেমে আসার আশঙ্কা আছে। এতে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার রোডম্যাপ কী হওয়া উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে মাসরুর আরেফিন বলেন, বর্তমানে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদর এনএভির নিচে। যখন বাজারের ৮০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারদর এনএভির ওপরে যাবে, তখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার ঘোষণা আসতে পারে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে উৎসাহিত হবেন।

দেশের পুঁজিবাজারে বড় পতন শুরু হয় ১৫ মার্চ। মাত্র তিনদিনের পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক হারায় ৫২৬ পয়েন্ট। প্রধান সূচক নেমে আসে হাজার ৬০৩ পয়েন্টে। অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ১৯ মার্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সার্কিট ব্রেকারের নিয়মে পরিবর্তন আনে। প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের আগের পাঁচদিনের ক্লোজিং প্রাইসের গড়কে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর হিসেবে বেঁধে দেয়া হয়। তবে সার্কিট ব্রেকারের আগের নিয়ম বহাল রাখা হয় দর বৃদ্ধিসহ অন্য ক্ষেত্রে। ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়ার পর পুঁজিবাজারে সূচকের পতন ঠেকলেও লেনদেন কমতে কমতে একদম তলানিতে নেমে আসে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ দেশে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। তার পর থেকে টানা ৬৫ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়। বাজার চালু হলেও লেনদেনের পরিমাণ ছিল খুবই কম। গত ২১ জুন ডিএসসিতে মোট লেনদেন হয় মাত্র ৩৮ কোটি টাকা, যেটি ঢাকার পুঁজিবাজারে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন। তবে চলতি সপ্তাহে পুঁজিবাজারের লেনদেন ছিল কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী।

একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর পরামর্শ হলো, ফ্লোর প্রাইস তোলার ক্ষেত্রে ডিএসইর প্রধান সূচককে মাপকাঠি ধরা যেতে পারে। বিএসইসি যদি ঘোষণা দেয়, ডিএসইর প্রধান সূচক হাজার পয়েন্ট বা তার বেশি উঠলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হবে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবেন। এতে বাজারের স্বাভাবিক পরিস্থিতিও ফিরবে। আবার একসঙ্গে ফ্লোর প্রাইস তুলে না দিয়ে, ধাপে ধাপে খাতভিত্তিক ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার রোডম্যাপও ঘোষণা দেয়া যায়।

ফ্লোর প্রাইস তোলার বিষয়ে একটি রেডম্যাপ থাকতে পারে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা . বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও। শেয়ারবাজারের বিশেষজ্ঞ এর আগে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া যাবে না। এটি অবশ্যই সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত রাখতে হবে। তারপর ভাবতে হবে কবে থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া যায়। সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ না হলেও ফ্লোর প্রাইসের বিষয়ে একটি রোডম্যাপ থাকতে পারে। এতে বাজারের অনিশ্চয়তা কিছুটা হলেও কমবে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, শেয়ারবাজারের বিদ্যমান ধন্যতার জন্য শুধু ফ্লোর প্রাইস কিংবা মহামারী দায়ী নয়। পুঁজিবাজারের বাইরের সমস্যাগুলোই এটিকে বিধ্বস্ত করেছে। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা শেয়ারবাজারের অস্থিরতার জন্য অন্যতম দায়ী। বর্তমানে দেশের উৎপাদন, বিপণন, আমদানি-রফতানি, রাজস্বসহ সব খাতই বিপর্যস্ত। এগুলো ঘুরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত পুঁজিবাজার ভালো হবে, এটি আশা করা ঠিক নয়।

দেশের পুঁজিবাজারে নিম্নমুখিতার শুরু ২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে। মাঝেমধ্যে সূচকের উত্থান দেখা গেলেও সার্বিকভাবে ক্রমশ নিচের দিকেই নেমেছে সূচক। পতনের ধারাবাহিকতা ছিল চলতি বছরেও। টানা দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নাভিশ্বাস চরমে উঠে গেলে একসময় তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও করেন। পুঁজিবাজারে টানা দরপতন ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় বেশকিছু পদক্ষেপ। এর মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ানো ছিল অন্যতম। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে -সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর মাধ্যমে তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রতিটিকে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়।

বিশেষ তহবিল গঠনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাজারে। বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় সে সময় ডিএসইর লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারির পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩টি ব্যাংক তহবিল গঠনের আবেদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। অথচ দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬০। ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় পুঁজিবাজারেও। তার ওপর করোনাভাইরাস আতঙ্কে পুঁজিবাজারে দরপতন আরো তীব্র হয়ে ওঠে।

ব্যাংকগুলোকে বাজারমুখী করার জন্য এরই মধ্যে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা অগ্রণী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। চিঠিতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য প্রতিটি ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার যে বিশেষ তহবিল গঠন করার কথা, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। এরই মধ্যে বিএসইসির দেয়া চিঠির জবাব দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বেশির ভাগ ব্যাংকই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে গতানুগতিক উত্তর দিয়েছে। সহসা বাজারে বিনিয়োগ বাড়াবেন, এমন প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি ব্যাংকগুলো থেকে।

বিষয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের ভাষ্য হলো, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ শেয়ার কিনলে, বাজারের পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য। ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার করা অর্থ দিয়ে শেয়ার কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ বাজার খারাপ, অজুহাতে ব্যাংকগুলো বিশেষ তহবিল গঠন কিংবা শেয়ার কেনা থেকে বিরত থেকেছে। এটি ঠিক নয়, আমরা বাজারে দুঃসময়ের বন্ধু চাই। সুসময়ের বন্ধু আমাদের দরকার নেই। আমরা ব্যাংকগুলোকে বাজারে ফেরাতে চাই।

ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে কী ভাবছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় সংকট হলো আস্থার ঘাটতি সুশাসনের অভাব। বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংক ব্রোকারেজ হাউজগুলো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা লেকসানে আছে। দিন দিন লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। অবস্থায় বাজারে বিনিয়োগে যে কেউ বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবে, এটিই স্বাভাবিক।

তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন হয়েছে। এর ফলে বাজারে একটি ইতিবাচক বার্তা গেছে। তবে এখনো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনেক সংস্কারমূলক কাজ করতে হবে। ফ্লোর প্রাইস কবে তোলা হবে সেটিও বিনিয়োগ না বাড়ার বিষয়ে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন