কাজ বন্ধ, অনিশ্চয়তায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতের ভবিষ্যৎ

তানিম আহমেদ

শখের বশেই ফটোগ্রাফি করতেন নারায়ণগঞ্জের জনি হোসাইন। পড়াশোনা শেষ করে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ফটোগ্রাফির আয় দিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলছিল তার। কিন্তু করোনা মহামারীতে সব কিছু থমকে গেছে। গণজমায়েতসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধে আয় বন্ধ তার। লকডাউনের পর নিজের জমানো টাকা শেষের পথে। এখন চিন্তিত নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

হূদয় (ছদ্মনাম) বিভিন্ন ইভেন্টে নিয়মিত ছবি তুলতেন। ভালোই চলছিল সব কিছু। সময়ের সঙ্গে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে সেটআপও বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারীতে হূদয়ের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। কাজ বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার। বাধ্য হয়ে শখের ক্যামেরা বিক্রি করে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন রাজধানীতে।

জনি হূদয়ের মতো হাজারো তরুণ করপোরেট ইভেন্ট ওয়েডিং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে ফ্রিল্যান্সিং করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারীতে কাজ হারিয়ে সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে রয়েছেন তারা।

জনি বলেন, কাজের স্বাধীনতা থাকায় ফ্রিল্যান্সিং পেশা হিসেবে এটাকে পছন্দ করেছি। শুরুর দিকে করপোরেট ফটোগ্রাফি করলেও পরে শুধু ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতাম। এতদিন ভালোই চলছিল সব। কিন্তু করোনার কারণে সবই বন্ধ। আগে প্রায় প্রতিদিনই ইভেন্ট থাকত। এপ্রিলেও অনেক বুকিং ছিল। সেগুলো বাতিল করেছি। বুকিং মানিও ফেরত দিয়েছি। সেভিং দিয়ে কয়েক মাস চলেছি। এখন সামনে কীভাবে চলব বুঝতেছি না। এত খারাপ অবস্থায় পড়ে যাব সেটা কখনই বুঝতে পারিনি।

জানা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের যাত্রা ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে। মূলত ২০০২ সালের পর থেকেই এটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। তবে এক দশক ধরে ব্যাপক জনপ্রিয় নতুন ধারণার ব্যবসা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশাল আয়োজনের ট্রেড শো, যে অনুষ্ঠানই হোক না কেন কোনো ঝক্কি-ঝামেলার মুখোমুখি না হতে অনেকেই নির্ভর করছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। খাতের চাহিদা বাড়ায় পুরনোদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই যুক্ত হয়েছিলেন ব্যবসায়। কিন্তু করোনার কারণে ছোট ছোট ইভেন্ট কোম্পানি এরই মধ্যে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। আর পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে সংকটে পড়বে খাতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান।

দেশে দুই ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করে। একটি হলো করপোরেট ইভেন্ট, অন্যটি হলো ওয়েডিং ইভেন্ট। করপোরেট ইভেন্টে যারা কাজ করেন তারা সরকারি, বেসরকারি, ব্যাংক, বীমা বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজ করেন। আর ওয়েডিং ইভেন্টে বিয়ে, জন্মদিনের প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে কাজ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের তালিকায় রয়েছে পণ্যের প্রচার, পণ্যের ওপর জরিপ কার্যক্রম, মেলা, কনসার্ট, বার্ষিক অনুষ্ঠান, পুনর্মিলনী, গায়েহলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জনসংযোগ ব্যবস্থাপনা।

জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে পাঁচ শতাধিক ছোট-বড় করপোরেট ইভেন্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করে। আর ওয়েডিং ইভেন্ট প্রতিষ্ঠান আছে তিন শতাধিক। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে প্রায় ৩০০টির মতো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেলার প্রতিষ্ঠানগুলো বিয়ে-করপোরেটসহ সব অনুষ্ঠানই আয়োজন করে থাকে।

এছাড়া ফেসবুকভিত্তিক ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে কাজ করেন অনেক তরুণ। খাতে স্থায়ী, অস্থায়ী, সাপোর্টিং মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোক কাজ করে থাকেন। এর বার্ষিক টার্নওভার প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

খাতে কর্মরতরা বলছেন, পাঁচ বছর আগেও ঢাকা চট্টগ্রামের বাইরে তেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ছিল না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচার প্রসার বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং মানুষের ব্যবসা বাড়ায় জেলা পর্যায়েও এর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গড়ে উঠেছে অনেক ইভেন্ট প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে অনেক তরুণই স্বাধীন সৃষ্টিশীল পেশা হিসেবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাও পার্টটাইম হিসেবে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে বাড়তি আয় করতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, লকডাউনে কাজ না থাকায়, আমাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দিলেও আমাদের কোনো লাভ নেই। কারণ গত চার মাসে প্রায় ৩০ শতাংশ ছোট ছোট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী চার মাসে আরো ৩০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ এক বছর পর্যন্ত দেখবে।

তিনি বলেন, মানুষজনের সমাগম ছাড়া তো কোনো ইভেন্ট করা যায় না। আমাদের খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অফিস বন্ধ চার মাস ধরে। লকডাউন খুললেও আমরা কোনো কাজ পারব না। কাজ পেতে পেতে ছয় মাস লেগে যাবে। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। সবকিছু স্বাভাবিক হলেই আমরা কোনো ইভেন্ট পাব না। কারণ মানুষ স্বাভাবিক হবে, তাদের কাছে টাকা-পয়সা আসবে। টাকা-পয়সা আসার পরই তারা ইভেন্ট শুরু করবে। মানে আরো ছয় মাস। খুললেই আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না।

বিডি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ওয়েডিং প্ল্যানার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইনুর হোসাইন নেহাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার পর্যন্ত ১১০ দিন তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কোনো প্রোগ্রাম নেই, অফিস ভাড়া স্টাফদের বেতন দিতে হচ্ছে। অফিস খুলতে হচ্ছে সপ্তাহে একদিন। কারণ মালামাল তো দেখাশোনা করতে হয়। কিন্তু আমাদের তো কোনো আয় হচ্ছে না। সামনে আমরা কীভাবে চলব, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। এভাবে আর কতদিন চলব?

ইথ্রি সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম ভূঁইয়া। ১৩ বছর আগে শূন্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন তিনি। কিন্তু করোনার থাবায় সেই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ এখন হুমকির মুখে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এভাবে চললে কিছুদিন পর সবকিছুই গুটিয়ে নিতে হবে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠান ছোট করেছি। গত জুন পর্যন্ত ২৫ জন স্টাফ ছিল। আমি এবং পার্টনারসহ মোট সাতজন ছাড়া বাকিদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আর বলেছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, কোম্পানি চালু হলে তারা আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন। আর অফিসও ছেড়েই দিয়েছি।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএমএমএবি) সাধারণ সম্পাদক স্কাই ট্র্যাকার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দোজা এলান বণিক বার্তাকে বলেন, চার মাস ধরে আমাদের অফিস বন্ধ। কারণ কোনো কাজ নেই। আর যেগুলো ছিল, সেগুলোও মহামারীর কারণে স্থগিত। বেশির ভাগ এজেন্সির পুরো প্যাক কাজ ছিল। এখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ছিল। এছাড়া আরো কাজ ছিল। সেটা পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আর সংগঠনটির সভাপতি অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী মনে করেন, মুজিব বর্ষের কারণে এবার বছরটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতের জন্য সবচেয়ে লাকি বছর ছিল। তিনি বলেন, হাজার কোটি টাকার উপরে আয়োজনের বাজেট ছিল। এর প্রায় সব কর্মকাণ্ডই করত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টগুলো। কাজ করতে পারলে আমাদের সবারই লাভ হতো। কিন্তু করা হয়নি। অন্যান্য ব্যবসা খাতের কমবেশি আয় হচ্ছে, কিন্তু আমাদের জিরো।

খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রোজার মাসে এমনিই তাদের কাজ কম থাকে। তবে সময়ে ব্র্যান্ড প্রমোশন, করপোরেট ইফতারের আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এবার সেটাও হয়নি। অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর জানুয়ারিতে বেশি কাজ হয়ে থাকে। শীতের সময়ে অনেক কনসার্ট হয়ে থাকে। করোনার কারণে এসব বন্ধ হয়ে আছে। আর চলতি বছর কোনো ওপেন কনসার্ট আয়োজনেরও সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন