অন্তহীন ‘ভার্চুয়াল জীবনের’ আতঙ্ক

অলিভার ওহাং

আমার নামের প্রথম অংশটি থমাস দ্য ট্যাংক সম্পর্কিত শিশুদের বই দ্য রেলওয়ে সিরিজ থেকে নেয়া। আমার বড় ভাই বইটি পড়ছিলেন, অলিভার দ্য ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিন ছিল তার ফেভারিট। আমার মায়ের মনে হয়েছিল এই নামটি সুন্দর। যে কারণে একটি ট্রেনের নামে আমার নাম রাখা হলো।

এই নামের অবশ্য একটি কাব্যিক দিকও আছে। আমি জন্মেছি হুবহু দেখতে এক যমজ ভাইসহ। ইথান নামে সে ভাই আমি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। যমজ সম্পর্কে আপনাদের যদি জানা থাকে তবে জানবেন আমরা একই ধরনের জামা পরতাম, চুলে কাটও হতো একই। আমরা দেখতে যেমন একই রকম। আমাদের সঙ্গে আচরণও হতো একই রকম। সবকিছু একসঙ্গে।

বড় হতে হতে আমরা আলাদা পরিচয় তৈরি করেছি। আমাদের বন্ধুবান্ধব হয়েছে আলাদা, জামাকাপড়ও হয়েছে আলাদা। স্কুলে আমরা একজন আরেকজনকে এড়িয়ে চলতাম। এরপর আমরা আলাদা কলেজে ভর্তি হই। সময় প্রথম আমরা একজন আরেকজন থেকে আলাদা থাকা শুরু করি।

এটা আমার জন্য বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। যেখানে যমজ ভাইকে ছাড়া আমি আছি, মানুষ আমাদের একজনকে আরেকজনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে না। কিন্তু এই পরিবর্তন আমাকে আতঙ্কিতও করেছে। কলেজে একা একা আমার মনে হতো আমি কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি।

আমি এখন প্রায়ই বিচ্ছেদের মুহূর্তটি ভাবি, যেখানে কভিড-১৯-এর কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে এবং একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। হঠাৎ করেই যেন আমাদের শারীরিক যে নৈকট্য তা হারিয়ে গেল। অথচ আমরা তা নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলাম। আমি ভাবছি আমার ভবিষ্যতের জন্য এটি কী অর্থ বহন করছে। কেবল নিজের জন্যই, না আমার প্রজন্মের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও।

আমি পড়াশোনা করছি দর্শনশাস্ত্রে। যেখানে আমরা প্রথম দিকের একটি কোর্স ছিল চিন্তার নিরীক্ষা (থট এক্সপেরিমেন্ট) যা তৈরি করেছেন দার্শনিক ফ্রাঙ্ক জ্যাকসন, যা ম্যারি রুম নামে পরিচিত। ম্যারি নামে একজন দুর্দান্ত বিজ্ঞানী যিনি তার গোটা জীবন রঙহীন একটি ঘরে কাটিয়েছেন। যেখানে তার একমাত্র সংবেদনশীল ইনপুট ছিল একটি সাদাকালো টেলিভিশন স্ক্রিন।

ম্যারির কাছে রঙের ধারণা সম্পর্কে অসংখ্য তথ্য ছিল, সে সবকিছু জানত। সে কেবল নিজের রঙের ধারণা লাভ করেনি। এরপর একদিন সে ঘরের মাঝে হাঁটার সময় নীল আকাশ দেখে। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, সে কি নতুন কিছু জানল? অভিজ্ঞতায় পাওয়া বিশ্ব কি আমাদের এমন কিছু বলে যা আমরা কখনো পড়ার মাধ্যমে পেতে পারি না?

জ্যাকসনের উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। এসব জিনিস আমরা শারীরিক অভিজ্ঞতায় পাই, এগুলোকে তিনি বলেছেন কোয়ালিয়া। এগুলো সব জায়গায় আছে। কিন্তু ভার্চুয়াল জীবনে এদের পাওয়া যাবে না।

কয়েক বছর আমার ভেতর যে বিষয়টি কাজ করছিল তা হলো আমার যা করা প্রয়োজন তা আমি ভার্চুয়ালি করে ফেলতে পারি। আমি বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ সারতে পারি, লিখতে পারি, পড়তে পারি, প্রতিবেদন তৈরি করতে পারি, টেলিভিশন দেখতে পারি, লেকচার শুনতে পারি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রমণ করতে পারি। এরপর আমার ক্লাসগুলো যখন মার্চের শেষ দিকে অনলাইনে নেয়া শুরু হয়, এখানে আমি আসলে আরো বেশি কিছু করতে পারি। আমার প্রফেসরদের আগের চেয়ে বেশি সময় পাওয়া যাচ্ছে। আমার কাজে বিঘ্ন কম ঘটছে এবং অনেক উপকরণ পাওয়া সহজ হচ্ছে।

লকডাউনে আমি বাড়ি ফিরে এলে, আমার জীবন আগের মতোই চলছিল। আমার মা একজন থেরাপিস্ট। তিনি অনলাইনে রোগী দেখছিলেন, আমার বোন জুমে ক্লাস নিচ্ছিল। সবকিছুই আসলে ভার্চুয়ালে পরিণত হয়ে গেছে। একটি ভিন্ন বাস্তবতা।

ভার্চুয়াল লাইফ আমাদের জেনারেশনের স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমি বড় হয়েছি কম্পিউটারের সঙ্গে। ক্রমেই যেখানে প্রবেশ সহজতর হয়েছে। এমনকি মহামারীর আগেও আমি শনিবার নিজের রুমে একাকী কাটাতাম নিজের ল্যাপটপ ফোনের সঙ্গে। যেখানে আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম এবং খেলার হাইলাইটস দেখতাম। কলেজের পরও আমার ভার্চুয়াল কাজের জগতে প্রবেশ করি। সব জায়গায় কম্পিউটার মানুষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমি ধারণা করি আমার বেশির ভাগ বন্ধুর পেশাদার জীবন কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা কিংবা ফোনে কথা বলা।  লেখক হিসেবে আমার কাজ আমি ঘরে বসে করতে পারি। এরই মধ্যে আমি আমার অর্ধেক জীবন অনলাইনে কাটিয়ে দিয়েছি।

আমার মতো অনেক তরুণের জন্য প্রাথমিক ভয়টা অবশ্যই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া নয়, সেটি হচ্ছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এখানে ভয়ের অনেকগুলো সম্ভাব্য দিক আছে। প্রতিদিন নতুন কিছু সেখানে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু আমি যে ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা চিন্তা করছি, তা হলো ভার্চুয়াল জীবনের সর্বব্যাপিতা কখনো দূরে সরে যাবে না। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মহামারীর এই অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে, শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন থেকেও বেঁচে থাকা সম্ভব।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন