কভিডকালীন পালাবদল

বৈশ্বিক কূটনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের অগ্নিপরীক্ষা

মোহাম্মদ এ. আল এরিয়ান

চাপের সময়ে দীর্ঘ-দমিত স্ববিরোধগুলো জনসম্মুখে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চীন-হংকয়ের সাম্প্রতিক ঘটনায় হঠাৎ করে তাই-ই হয়েছে। চীন এখন এ ধরনের দুটি স্ববিরোধের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। উভয় স্ববিরোধ তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণাম ঘটাতে পারে। 

প্রথমোক্ত স্ববিরোধ হলো, গত বৃহস্পতিবারে দেয়া বেইজিংয়ের সংকেত। এ সংকেত অনুযায়ী দেশটি জাতীয় নিরাপত্তা বিধির অধীনে হংকংয়ের ওপর শাসনতান্ত্রিক বা আইনগত নিষেধাজ্ঞা কঠোর করতে চায়। এটি ‘এক দেশ, দুই শাসনব্যবস্থা’ প্যারাডাইমের অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যকে সামনে এনেছে। মূলত এ স্ববিরোধী প্যারাডাইমের মাধ্যমে প্রায় গত তিন দশক পর্যন্ত দুটি রাষ্ট্রের (দলিল-দস্তাবেজে হংকং অবশ্য চীনের একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলমাত্র) সম্পর্ক পরিচালিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাজ্য হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর করেছিল। ওই সময় চীন হংকংয়ের অর্থনৈতিক, আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫০ বছরব্যাপী ট্রানজিশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এত সময় পেরোনোর পরেও আলোচ্য প্রতিশ্রুতির তেমন প্রতিফলন এখনো দৃশ্যমান নয়।

সময়ের আবর্তে ‘এক দেশ, দুই শাসনব্যবস্থা’ ধারণা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা চীন ও হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি সংঘাত উসকে দিয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘোষণা আইনে বিধিবদ্ধ হলে সঙ্গতকারণে তা উভয়কেই আরো উত্তেজিত করে তুলবে।

হংকং এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি জোরোলা ধারণা আছে যে, নিজের জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক অভিপ্রায় সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য চীন কভিড-১৯ সংকটে নিমজ্জিত থাকা বিশ্বের সাধারণ ব্যস্ততাকে কাজে লাগাচ্ছে। মূলত এরই ধারাবাহিকতায় হংকংয়ের ওপর অধিক চাপ দেয়া, সামরিক বাজেট বাড়ানো, আরো আগ্রাসী আঞ্চলিক উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং নিজেকে নির্ভরযোগ্য পরাশক্তি মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ‘ফেস মাস্ক’ কূটনীতি প্রবর্তন করেছে। চীনের এ প্রবণতা এশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যদিও অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে, তবে এর বিরুদ্ধে তাদের দিক থেকে ততটা কার্যকর পুশব্যাক দৃশ্যমান নয়।

হংকংয়ের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে চীনের অভিলাষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিষ্ক্রিয়তার বদল হতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র  ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা শুরু করতে যাচ্ছে। 

হংকং পরিস্থিতি দ্বিতীয় একটি স্ববিরোধের বয়ানকেও শক্তি জোগাচ্ছে; বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাজারের সঙ্গে যার আরো প্রত্যক্ষ প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। খুব সামান্য বৈশ্বিক অঙ্গীকার ও দায়িত্বশীলতা দেখিয়ে চীন এতদিন অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য পূরণ করেছে মাত্র, বিশ্বব্যবস্থার লক্ষ্যণীয় উন্নয়ন ঘটায়নি। কাজেই ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্টের দিক থেকে চীনকে একটি দৃঢ় সংকেত দেয়ার সময় এসেছে যে, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।’ 

পশ্চিমের অনেক বিশ্লেষকই হংকংয়ের সিগন্যালকে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অধিকারবিষয়ক আইন, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক পেমেন্টে বহুপক্ষীয় ভিত্তির প্রতি কেবল চীনের আংশিক আনুগত্যের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তির ছায়াতলে অন্য দেশগুলো বরাবরই চীনকে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও আর্থিক প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এতে দেশটি তার চমকপ্রদ উন্নয়ন প্রক্রিয়া বেগবান করতে সমর্থ হলেও অন্য দেশগুলো খুব একটা উপকৃত হয়নি। 

এদিকে চীন ও হংকংয়ে ব্যাপকভাবে উন্মোচিত কোম্পানিগুলোর চ্যালেঞ্জ বাড়ানো ছাড়াও এটি (হংকং পরিস্থিতি) অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশগুলোর ওপরও ভালোই চাপ সৃষ্টি করবে, যেসব দেশ ‘ডুয়্যাল অপশন’ কৌশল বজায় রেখে চলেছে। একদিকে ওইসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার বলয়ের নির্ভর করছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও আর্থিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।

এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, একটি তীব্রতর হওয়া ‘শীতলযুদ্ধ’ বি-বিশ্বায়ন, বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা এবং অর্থনৈতিক টুলসের অস্ত্রীকরণ ঘটাতে পারে, যার সবগুলোই করোনাভাইরাসের অভিঘাত থেকে  এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জের শিকার হওয়া পুনরুদ্ধারকে আরো নিষ্প্রভ করবে। আর্থিক বাজার এবং অর্থনৈতিক ও করপোরেট ফান্ডামেন্টালসের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তীব্র নজরদারি ও চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, ঊর্ধ্বমুখী সম্পদ দাম ধরে রাখতে গিয়ে ভবিষ্যৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা ও বাজার কার্যকারিতা যাতে বিনষ্ট না হয়।   

লেখক: মোহাম্মদ এ. আল এরিয়ান: অ্যালায়েঞ্জ এসইর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ব্লুমবার্গ ভিউ থেকে ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন